কাঁচে ঘেরা একটি বৃক্ষখণ্ড। আপাতদৃষ্টিতে শুষ্ক প্রাণহীন কাঠখণ্ড মাত্র।
কিন্তু বাঙালির ইতিহাসের অবিস্মরণীয় অধ্যায়ের নীরব সাক্ষী এ বৃক্ষখণ্ডের
সামনে দাঁড়ালেই ৬৩ বছর আগের এক রৌদ্রকরোজ্জ্বল দুপুর যেন চোখের সামনে ভেসে
ওঠে। সেদিন বৃক্ষটি নীরবই ছিল, কিন্তু তার নিচে সরব হয়ে উঠেছিল ছাত্র-জনতা।
এ আমতলাতেই সিদ্ধান্ত হয়েছিল সরকারি নির্দেশ অমান্য করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের।
সেই আমতলা এখন আর নেই। তবে মৃত গাছটির একটি খণ্ড কালের সাক্ষী হয়ে
অস্তিত্বমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু সংগ্রহশালায়। ৬৩ বছর আগে যেভাবে
ভাষার অধিকার আদায়ের আন্দোলনে এখনো ঠিক একইভাবে সাক্ষী হয়ে রয়েছে।
ডাকসু সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত ঐতিহাসিক আমগাছের খণ্ডটি দর্শনার্থীদের নিয়ে
যায় ভাষা সংগ্রামের দিনগুলোতে। দর্শক স্মৃতি-কল্পনায় ফুটে ওঠে বায়ান্নর
একুশে ফেব্রুয়ারি সকাল। সেবার ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহেও প্রকৃতিতে শীতের
দাপট কমেনি। তবে ভাষার অধিকারের প্রশ্নে ছাত্র-জনতার রক্ত-ধমনিতে তখন
বিদ্রোহ-বিপ্লবের আগুন। ১৪৪ ধারা ও পুলিশের সকল মহড়ার ভ্রূকুটি উপেক্ষা করে
ঢাকায় অবস্থানরত ছাত্র-জনতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে জমায়েত হতে
থাকে। সকাল প্রায় ১১টার দিকে ভাষা সংগ্রামী গাজীউল হকের সভাপতিত্বে তখনকার
‘কলা ভবন’ প্রাঙ্গণে আমতলায় শুরু হয় ছাত্রসভা। ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে
বিপক্ষে নানা মত আসতে থাকে। অবশেষে সংখ্যাগরিষ্ঠের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন
ঘটে। আমতলা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটক দিয়ে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে মিছিল
বের হয়। এরইমধ্যে দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়েছে। আইন পরিষদ ভবন ঘেরাওয়ের লক্ষ্যে
ছাত্রদের মিছিল এগুতে শুরু করলে গুলি করে পুলিশ। ঢাকার রাস্তা রঞ্জিত হল
ছাত্র-জনতার রক্তে। ফাগুনের উজ্জ্বল বিকাল পরিণত হলো শোকের সায়াহ্নে। যে
শোক থেকে শক্তি ও অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে, সংগ্রামের পথ বেয়ে প্রতিষ্ঠা পায়
রাষ্ট্রভাষা বাংলা।
ভাষা আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল ১৯৫২
সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে আমতলার ঐ ছাত্রসভা। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রামে অন্যতম
প্রধান স্মৃতি-স্মারক সেই আমগাছ। বাঙালির সংগ্রামী ঐতিহ্যের চিহ্ন সেই
আমগাছ কিংবা আমতলা আর নেই। সংরক্ষণ না করায় কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে তার
অস্তিত্ব। মৃত আমগাছটির মূল কাণ্ডের একটি অংশ সংরক্ষিত আছে ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ- ডাকসুর সংগ্রহশালায়। বায়ান্নর
রক্তকরবীর উজ্জ্বল স্মৃতিচিহ্ন।
বর্তমান ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ
হাসপাতালই ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তখনকার কলা ভবন। গাছটির উত্তর-পশ্চিম
দিকে ছিল মধুর ক্যান্টিন। পূর্বদিকে বেলতলায় একটি ছোট পুকুর।
দক্ষিণ-পশ্চিমে বঙ্গভঙ্গ আমলের স্থাপত্য -আর্টস বিল্ডিং (কলা ভবন)। এ ভবনের
সীমানা প্রাচীর তখনকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল।
১৯৬১-৬২ সালে কলা অনুষদের কার্যক্রম বর্তমান ভবনে স্থানান্তর করা হয়। এ ভবন
স্থানান্তরের পর থেকেই আমগাছটির প্রতি যত্ন কমতে শুরু করে। বর্তমান ঢাকা
মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ফটকের সামনের এলাকায় ছিল গাছটি।
প্রাকৃতিক নিয়মে একসময় মারা যায় স্মৃতিময় আমগাছ। দীর্ঘদিন ধরে জীর্ণদেহ
নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল গাছটি, একা।
ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিস্মারক
আমগাছটি শুধু সেই একুশে ফেব্রুয়ারির আন্দোলনের স্মৃতিই বহন করে না।
আন্দোলনের পরবর্তী পর্যায়ের বেশ কয়েকটি সভা-সমাবেশও হয়েছিল এখানে। ১৯৫৩ সাল
থেকে মুক্তিযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত ভাষা শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা
জানাতে এ স্থানে জড়ো হতেন ভাষা সংগ্রামী ও সর্বস্তরের জনগণ। ১৯৫৩ সালের ২১
ফেব্রুয়ারিকে ‘শহীদ দিবস’ পালনের অন্যতম কেন্দ্রভূমিও ছিল এ আমতলা। ঐ বছর
একুশে ফেব্রুয়ারি খুব ভোরে প্রভাতফেরি করে আজিমপুর গোরস্থানে যায়
ছাত্র-জনতা। সেখানে শহীদদের মাজারে দোয়া পাঠ ও পুষ্পস্তবক অর্পণ করে।
রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ও ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে ঐ এলাকা থেকেই ছোট ছোট
মিছিল নিয়ে রাস্তায় নামেন তারা। মিছিলগুলো আমতলায় এসে মিলিত হয়। ড.
মোহাম্মদ হান্নানের ‘বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস, ১৮৩০ থেকে ১৯৭১’
বইয়ে উল্লিখিত তথ্য মতে, ঐ দিন দুপুরের দিকে আমতলা থেকে ৩০ হাজারের বেশি
ছাত্র-জনতার একটি বিরাট মিছিল আরমানিটোলা ময়দানে সর্বদলীয় কর্মপরিষদের
জনসভায় যোগদানের উদ্দেশে রওয়ানা দেয়। মিছিলে স্লোগানে ওঠে ‘রক্তের বদলে
রক্ত চাই, খুনি নূরুল আমিনের কল্লা চাই’, ‘শহীদ স্মৃতি অমর হোক’,
‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। তত্কালীন আওয়ামী মুসলিম লীগের আতাউর রহমান খান ও
শেখ মুজিবুর রহমান এবং যুবদলের ইমাদুল্লাহ মিছিলে নেতৃত্ব দেন। মিছিলে
স্বেচ্ছাসেবকদের অধিনায়ক ছিলেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এমএ ওয়াদুদ।
বায়ান্নতে ছাত্রদের উপর পুলিশের গুলিবর্ষণের পর ভাষা আন্দোলন কিছুটা
স্তিমিত হয়ে পড়েছিল। ১৯৫৬ সালে আন্দোলন আবারো পূর্ণদ্যোমে শুরু হয়।
রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে রাস্তায় নামতে শুরু করে ছাত্র-জনতা। ১৯৫৬ সালের
২৯ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা সাংবিধানিকভাবে
গৃহীত হয়। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠা পায় বাংলা বর্ণমালা। ১৯৫২ থেকে ‘৫৬-র
আন্দোলনের প্রস্তুতিপর্বে আন্দোলনের নেতা-কর্মী-সংগঠকদের অন্যতম প্রধান
মিলনস্থল ও সভাস্থল ছিল এ আমতলা এবং সংলগ্ন এলাকা।
স্মৃতির আমতলা
বায়ান্নর রক্তঝরা ফাগুন এবং ছাপান্নর রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতির
সাক্ষী আমতলা। আন্দোলনকারীদের পদভারে যে এলাকা ছিল সবসময় চঞ্চল-জাগ্রত।
ধীরে ধীরে সে এলাকাই প্রায় পরিত্যক্ত এলাকায় পরিণত হয়। অযত্ন-অবহেলায় মারা
যায় ঐতিহাসিক আমগাছ। এরইমধ্যে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল বর্ধিতকরণের
প্রয়োজন হয়। ১৯৯৫ সালের ২১ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তখনকার প্রক্টর
অধ্যাপক নজরুল ইসলাম ডাকসুকে এক চিঠির মাধ্যমে গাছটি কেটে ফেলার অনুমতি
দেন। পরের দিন ২২ নভেম্বর দুপুরে গাছটি কেটে ফেলা হয়। মৃত আমগাছটির মাটির
উপরের মূল কাণ্ডের উপরের অংশটি কেটে নিয়ে আসে ডাকসু সংগ্রহশালা।
এ প্রসঙ্গে ডাকসু সংগ্রহশালার সংগ্রাহক গোপাল দাস জানান, মৃত গাছটিতে তখন
অনেক পোকা ছিল। সেগুলো দূর করে কাঠ বার্নিশ তেল দিয়ে বৃক্ষখণ্ডটিকে সংরক্ষণ
করা হয়েছে। ১৯৯৫ সালের ৬ ডিসেম্বর ডাকসু ভবনে গাছের খণ্ডটি প্রদর্শনের
জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়। পরে এটিকে কাঁচঘেরা করা হয়।
কাঁচঘেরা আমগাছটি এখন ভাষা আন্দোলনের চেতনা ছড়িয়ে দিচ্ছে। প্রতিদিন সকাল
থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার
মানুষ ডাকসু সংগ্রহশালা পরিদর্শন করেন। একপর্যায়ে তারা থমকে দাঁড়ান
আমগাছটির সংরক্ষিত খণ্ডের সামনে। তারা যেন দাঁড়িয়ে পড়েন ভাষা আন্দোলনের
অগ্নিঝরা প্রতিবাদমুখর দিনগুলোর সামনে।