চাকরিতে নিয়োগ, বদলি এমনকি পদোন্নতির নথিও নড়ে না তদ্বির বা সুপারিশ ছাড়া।
কার্যত তদ্বিরই নিয়োগের নিয়ামক হয়ে উঠেছে। এই ‘তদ্বির সংস্কৃতি’ চালু
হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রেই পক্ষপাতহীন ভাবে কাজ করতে পারছেন না অনেক সরকারি
প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কর্তৃপক্ষ। আবার যোগ্যরাও বাদ পড়ে যাচ্ছেন তদ্বিরের
কারণেই। এটি বেশি হচ্ছে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর নিয়োগের ক্ষেত্রে। অভিযোগ
রয়েছে, তদ্বিরের চাপ সামাল দিতে না পারায় বা তদ্বির এড়াতে সরকারের বিভিন্ন
মন্ত্রণালয় ও বিভাগে অসংখ্য শূন্য পদের নিয়োগ প্রক্রিয়া আটকে আছে। এসব
নিয়োগ ঝুলে আছে বছরের পর বছর। যদিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বার বার ওই
নিয়োগ দ্রুততার সঙ্গে শেষ করার তাগিদ দিয়ে আসছেন। কিন্তু তারপরও নিয়োগ
প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
দেশের শীর্ষ
প্রশাসনিক দপ্তর সচিবালয় থেকেই উন্নয়নসহ সকল কাজের সিদ্ধান্ত ও বাস্তবায়নের
নির্দেশনা জারি হয়। মন্ত্রী-এমপিদের এলাকা ভিত্তিক উন্নয়ন, স্থানীয়
প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়োগ-বদলির বেশিরভাগই হয়ে থাকে এই
সচিবালয়ের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ থেকে। সচিবালয় ঘুরে দেখা গেছে,
ব্যতিক্রম ক্ষেত্র ছাড়া মন্ত্রী-এমপিদের সুপারিশ ভিন্ন কোনও কাজ হয় না।
সুপারিশ করে আবার লোক লাগিয়ে রাখতে হয় কাজটি শেষ করানোর জন্য-এমন
দৃষ্টান্তও রয়েছে ভুরি ভুরি।
তবে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন,
তদ্বির বা সুপারিশ আগেও ছিল, কিন্তু এটি এখন মোটাদাগে এক ধরনের সংস্কৃতিতে
পরিণত হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের মধ্যেও এক ধরনের মানসিকতা বদ্ধমূল
হয়েছে যে সুপারিশ না আসলে কাজ ফেলে রাখা যাবে। এর কারণ সম্পর্কে বলতে গিয়ে
সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, মন্ত্রী, এমপি বা প্রভাবশালী মহলের
সুপারিশ ছাড়া কোন কাজ করলে পাল্টা ধমক শুনতে হয়, অনেক সময় হয়রানির মুখেও
পড়তে হয়। তবে পাল্টা অভিযোগও রয়েছে। ‘টু-পাইস’ পাওয়ার জন্যও নথি ফেলে রাখার
অভিযোগ রয়েছে কিছু কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে
জানা গেছে, স্থানীয় সরকার বিভাগের অধীনে পৌরসভার ৮০টি সচিব পদের জন্য ২০১৩
সালের জুলাই মাসে আবেদন আহবান করা হয়। প্রায় ৬ হাজার প্রার্থী এতে আবেদনও
করেন। কিন্তু যাচাই-বাছাই শেষে পরীক্ষা গ্রহণের পূর্ব মূহূর্তে স্থগিত করা
হয় এ নিয়োগ প্রক্রিয়া। আজ অবধি নতুন করে এ প্রক্রিয়া শুরু হয়নি। একই
বিভাগের কম্পিউটার অপারেটরের ১৩টি পদে ৫০০ প্রার্থীর নিয়োগ পরীক্ষাও বন্ধ
রয়েছে ওই বছরের জুলাই মাস থেকে।
ওই বছরের অক্টোবর-নভেম্বরের
রাজনৈতিক অস্থিরতার কথা বলে এ নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ করা হয়েছে-স্থানীয়
সরকার বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার এমন দাবি মানতে রাজি হননি অনেকেই। একজন
ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘অন্যায্য তদ্বিরের চাপ সামলানো সম্ভব হবে না
বলেই এটি বন্ধ রাখা হয়েছে। এখানকার কেউ ঝুঁকি নিয়ে কারো বিরাগভাজন হতে চান
না।’
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে শিক্ষা অধিদপ্তরের
অফিস সহকারী পদের নিয়োগ ঝুলে আছে সেই ২০০৪ সাল থেকে। প্রায় ৫ হাজার
আবেদনকারীর ভাগ্য ঝুলে আছে ১১ বছর। প্রতিদিনই অনেক ভুক্তভোগী মিরপুরের ওই
অধিদপ্তরে যান নিয়োগের ব্যাপারে জানতে। কর্মকর্তাদের একই জবাব, সময় হলেই
জানতে পারবেন। ফলে দূর-দূরান্ত থেকে আসা এসব অসহায় মানুষকে এক রাশ হতাশা
নিয়ে বাড়ি ফিরতে হচ্ছে। এছাড়া ভূমি মন্ত্রণালয়ের অফিস সহকারী ও সার্ভেয়ার
পদের নিয়োগও ঝুলে আছে। এক্ষেত্রে কয়েক বস্তা তদ্বিরের আবেদন জমা পড়েছে বলে
জানা গেছে।
এদিকে খাদ্য অধিদপ্তরের ‘অজ্ঞতা’র বলি হয়েছেন অসংখ্য
চাকরি প্রার্থী। নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করার পর মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কোটা
উল্লেখ না থাকায় তিন বছর পর নতুন করে আবার বিজ্ঞপ্তি দিতে হয়েছে। এই
বিজ্ঞপ্তির প্রেক্ষিতে আবেদন গ্রহণ, পরীক্ষা শেষ করে নিয়োগ সম্পন্ন করতে
প্রায় এক বছর লেগে যাবে-এমনটাই ভাবছে অধিদপ্তর।
সংশ্লিষ্টরা
বলছেন, তদ্বিরে ব্যস্ত অনেক মন্ত্রী-এমপি আর প্রভাবশালী মহল। আর এদের সকলের
চাপের মুখে অসহায় নিয়োগ কমিটি। ফলে অনেক ক্ষেত্রে লোক দেখানো নিয়োগ
পরীক্ষা (মৌখিক বা লিখিত) নেয়া হচ্ছে। শেষ বিচারে সুপারিশের প্রার্থীরাই
নিয়োগ পাবেন, কিন্তু আর্থিক ও মানসিক হয়রানির শিকার হবেন লাখ লাখ বেকার
যুবক। একটি আবেদন করতে কমপক্ষে ২শ’ টাকা খরচ হয় বলে চাকরি প্রার্থীরা
জানিয়েছেন। আর দীর্ঘদিন নিয়োগ ঝুলে থাকার কারণে অনেকের চাকরির বয়সও চলে
যাচ্ছে। এখন ভাগ্যকে দোষ দেয়া ছাড়া তাদের কি-বা করার আছে!