এ
দেশের মানুষ বনের নাম রেখেছে ‘সুন্দর’। সেই বনে এক নদী আছে ‘পশুর’। মানুষ
যেখানে পশুদের জন্যও একটা নদীকে ছেড়ে দিতে পারে সেই তো ‘সুন্দরবন’।
প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের এই মেলবন্ধন অটুট থাকলে পুরো দেশটাই তো কত সুন্দর
হতে পারতো! চারদিকে যত দূর চোখ যায় সবুজ আর সবুজ। এ যেন সবুজের স্বর্গ।
সবুজের বুক চিরে বয়ে গেছে ছোট বড় কত নদী-খালের বহমান স্রোতোধারা। দুচোখ
জুড়ানো এই সুন্দরে চোখ আটকে থাকে। মাথার ওপর পাখপাখালির সুমধুর কলতানে
সবুজের ঘোর কাটে কী! হঠাৎ ছটফটিয়ে ছুটে চলা হরিণ শাবককে দেখতে দেখতেই চোখ
চলে যায় এক পাল হরিণের দিকে। এ যেন এক মায়াময় বিভ্রমের জগৎ। নিস্তরঙ্গ
শান্ত জলরাশিতে বিলি কেটে মৃদু শব্দে রাজহংসের মতো বয়ে চলে আমাদের জাহাজ।
আমরা চলে আসি বনের রাজা রয়েল বেঙ্গল টাইগারের রাজত্বে। দিন-রাত
বঙ্গোপসাগরের জোয়ার-ভাটায় নোনা জলে স্নাত সুন্দরবনে।
যাত্রা শুরুর গল্প
টানা হরতালের মধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের ক্লাস শুরু হলো মার্চের ২ তারিখ থেকে। এমন সময়ে একদিন প্রিয় বড় মামার ফোন! ফোন ধরতেই ভারী কণ্ঠে মামা বললেন, ‘বেড়াতে যাবি?’ আমি গোমড়া মুখে বললাম, ‘ক্লাস শুরু হয়ে গেছে, যেতে পারব না।’ কিন্তু মামার কথায় যখন জানতে পারলাম বেড়ানোর জায়গাটা সুন্দরবন! তখন তো আমার চোখ ছানাবড়া। সঙ্গে সঙ্গেই লাফিয়ে উঠে বলে দিলাম,‘মামা আমি রাজি।’ ফরিদপুরের কে এম কলেজ থেকে প্রতিবছরই শিক্ষক-শিক্ষিকা আর তাঁদের পরিবারের সদস্যদের জন্য একটা আনন্দ ভ্রমণের আয়োজন হয়। আমার বড় মামা মোসায়েদ হোসেন ঢালী এই কলেজের প্রিন্সিপাল। তাঁর সুবাদেই অতিথি হিসেবে আমিও জুটে গেলাম এবারের আনন্দভ্রমণে। মার্চের প্রথম সপ্তাহেই মামা-মামি আর মামাতো বোন চারুর সঙ্গে আমিও সুন্দরবনে যাত্রা করলাম। ফরিদপুর থেকে বাসে খুলনার রূপসা ঘাট। সেখান থেকে তিনতলা জাহাজে সুন্দরবন।
সকালে কোকিলমনি, বিকালে কটকা
ভোরবেলায় মামার ডাকে ঘুম ভাঙল। জাহাজের কেবিন থেকে বেরিয়েই আমি হতবাক। নদীর দুইপাড় ধরে যত দূর চোখ যায় সবুজের মেলা। এই সবুজ যেন খালি আরও কাছে ডাকে। কিছুক্ষণ জাহাজের রেলিঙে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ বিস্ময় তাকিয়ে থাকলাম। হঠাৎ পড়িমরি করে ছুটলাম ক্যামেরা আনতে। পটাপট ছবি তুলতে তুলতেই দেখলাম, অন্যরাও ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে গেছে। তবে কিছুক্ষণ পরই ছবি তোলার উৎসাহে ভাটা পড়ল। বুঝলাম, এ সৌন্দর্য ক্যামেরায় ধরে রাখা যায় না, এটা অনুভব করতে হয়।
রাতে ছোটখাটো একটা ঝড় হয়েছিল। তার জের ধরে সকাল থেকেই দফায় দফায় বৃষ্টি। আবহাওয়া খারাপ থাকায় আমরা হিরণ পয়েন্টে নামতে পারলাম না। শেষমেশ এগারোটা নাগাদ হালকা বৃষ্টির মধ্যে আমরা প্রথম স্পষ্ট হিসেবে কোকিলমনি ঘাটে নামলাম। জাহাজ থেকে ছোট ল্যাংবোটে করে আমাদের যেখানে নামিয়ে দেওয়া হল। কোকিলমনি খুব বড় জায়গা না। মাঝে বড় একটা দিঘি। আমাদের দলের অনেকেই সেখানে গোসল করলেন। বাকিদের ঘোরাঘুরি আশপাশে। আমার নজর কাড়ল দিঘির পাড়ে দুটি বড় নৌকা।
ঘোরাঘুরি শেষে আমরা জাহাজে ফিরলাম দুপুরের খাবার খেতে। খাওয়া-বিশ্রাম সেরে জাহাজ রওনা দিল কটকায়। কটকায় নেমেই বড় একটা কাঠের সাঁকো। সাঁকোতে দাঁড়িয়েই দেখলাম বনের মধ্যে ঝাঁকে ঝাঁকে হরিণ চড়ে বেড়াচ্ছে। কাছে যাওয়ার চেষ্টা করতেই হরিণগুলো দৌড়ে পালায়। চিত্রা হরিণের মায়াময় মুখ দেখে মনে হল আহা! যদি একটু কোলে নিয়ে আদর করতে পারতাম! কিন্তু তাই-কী সম্ভব? বনের হরিণ তো বনেই থাকবে। অগত্যা ছবি তুলেই মনকে শান্ত করার চেষ্টা করতে থাকলাম। বেলা ঘনিয়ে এলে এল ফেরার পালা। কটকায় একটা জিনিস খুব চোখে পড়ল। সেটা হচ্ছে অসংখ্য গাছের কাণ্ড থেকে ভাঙা, শুধু গোড়া পড়ে আছে। সঙ্গী বনরক্ষী আলিম মামা জানালেন, ওগুলো ঝড়ে উপড়ে গেছে। আমাদের দেশকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবল থেকে রক্ষায় সুন্দরবনের ভূমিকা যে কতখানি তা যেন নিজ চোখে দেখে এলাম।
রাতের বেলায় জাহাজের ছাদে উঠলাম। নদীর মৃদু বাতাস মনটাকেই অন্যরকম করে দিল। জাহাজে উঠেই আপন, অনীক, জীবন, রাকিবের মত আমার সমবয়সী কয়েকজনের সঙ্গে পরিচয় হয়ে গিয়েছিল। সবাই মিলে গানের আসর বসালাম। ধীরে ধীরে আরও অনেকে এসে যোগ দিল। চলল আনন্দ-আড্ডা গান। আড্ডা শেষে কেবিনে ফিরে ঘুম। কিন্তু বনপরীরা যেন সব ঘুম কেড়ে নিয়েছে আমার। ফ্ল্যাশব্যাকের মতো সারা দিনের সব দৃশ্য একের পর এক চোখের সামনে। ঘোরাঘুরির কথা চিন্তা করতে করতেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম।
জামতলা সৈকত ও কচিখালি
রাতেই জেনেছিলাম সকালের গন্তব্য জামতলা সমুদ্র সৈকত। সকাল নয়টা নাগাদ পৌঁছে গেলাম। জামতলা সৈকতে যেতে প্রায় আধঘণ্টা হাঁটতে হলো একদম বনের ভেতর দিয়েই। খানিকটা যে ভয় লাগছিল না তা নয়। কিন্তু শ্বাসমূল এড়িয়ে এড়িয়ে বনপথে হাঁটা এতটাই উপভোগ করলাম যে কিছুই যেন টের পেলাম না। সৈকতে পৌঁছেই শুরু হয়ে গেল লাফালাফি! বালিতে-পানিতে মাখামাখি। আর লাফালাফির একটার পর একটা ছবি তোলা তো চলছেই। ফেসবুকে দিতে হবে না!
দুপুর নাগাদ আমরা পৌঁছালাম কচিখালিতে। এই খানে নাকি ঝাঁকেঝাঁকে হরিণ দেখা যায়। কচি খালিতে নামার পর অবশ্য পুরো দলটাই দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেল। একদল আর সামনে এগোতে চায় না! আমরা কয়েকজন তরুণ সামনে এগোতে থাকলাম, একসময় দেখলাম বাকিরাও আমাদের পিছু নিয়েছে। একটু সামনে গিয়ে দেখি একি! এ তো হাজারে হাজারে হরিণ! কিন্তু দূরে আমাদের দেখেই হরিণগুলো সচকিত। ছুটন্ত হরিণের পাল দেখতে যে কী সুন্দর! মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলাম।
আরেকটু এগিয়ে আমরা একটা বড় পাকুড় গাছের নিচে বসলাম। বনরক্ষী আলিম মামা শুরু করলেন মানুষখেকো বাঘের রোমহর্ষক গল্প। ওনার গল্প বলার ভঙ্গিতেই কিনা জানি না, দিনের বেলাতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। একটা গল্প মনে বেশ দাগ কেটে গেল মনে। এক লোকের রাতে পানির খুব পিপাসা লাগল কিন্তু ঘরে পানি নেই। বউয়ের নিষেধ না মেনে সে গেল নদী থেকে পানি আনতে। হঠাৎ গগনবিদারী চিৎকার আর বাঘের গর্জনে পুরো এলাকা প্রকম্পিত। বউটি তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বের হয়ে আধো আলোছায়ার মধ্যেই দেখতে পেল-একটা বাঘ মুখে করে কিছু একটা ঝুলিয়ে নিয়ে নদী পার হচ্ছে! বউটির আর বুঝতে বাকি থাকল না যে, তাঁর বরকেই বাঘে খেয়েছে! সুন্দরবনের মানুষদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভাবতে ভাবতে মন খারাপ নিয়ে কচিখালি থেকে ফিরে এলাম।
আমার সাতপুরুষের ভাগ্য সেই রাতে পূর্ণিমা হলো। বনে চাঁদের অসহ্য সুন্দর নরম আলোয় মনে কী যেন এক হাহাকারের গান। খালের পানিতে চাঁদের আলো চিকচিক করছে। যাওয়ার পথে চিটা-কটকা নামে একটা খাল দিয়ে গিয়েছিলাম। সেই খালের মধ্যে দিয়ে সুন্দরবনকে আরও কাছ থেকে গভীরভাবে দেখা গিয়েছিল। ভেবেছিলাম সারা দিনের সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত বুঝি এইটাই। কিন্তু পূর্ণিমার আলো সব ভুলিয়ে দিল। আজ আর জাহাজের ছাদে নয়। জাহাজের পেছনে বাঁধা ল্যাংবোটে গিয়ে বসলাম। সেখানে বাতাস অনেক কম। অনেক ছবি তুললাম আমরা। একটু পর পলি আপু, চারুসহ আরও কয়েকজন আসায় আবার হালকা গলায় গানের আসর। জোছনার আলোয় বনের হালকা বাতাসে গানে গানে মনে হলো আহ! ধন্য এ মানব জীবন!
ফেরার দিনেও ঘোরাঘুরি
ফেরার দিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই মনে বিষাদ। জাহাজ ছুটছে আপন গতিতে। এই জাহাজ আরও কতবার এই পথ দিয়ে যাবে কিন্তু তাতে আমি থাকব না! বিষণ্নতা ঝেড়ে নাশতা করার জন্য নিচে নেমে জানলাম আমরা ফিরব ভিন্ন একটা পথে। প্রথম গন্তব্য হাড়বাড়িয়া। তারপর করমজল। ভ্রমণের শেষ স্পট হিসেবে বেলা এগারোটায় নামলাম করমজলে।
সুন্দরবনে হরিণ, কুমির, শূকর আর পাখ-পাখালি ছাড়া খুব বেশি প্রাণী দেখিনি। আর বাঘ মামা তো ধারেকাছেই আসলেন না! তাই মনে একটা দুঃখ ছিল। কিন্তু দুঃখ আরও বেড়ে গেল সুন্দরবনের ভেতরেই করমজলের চিড়িয়াখানা দেখে! সেখানে হরিণ, বানর, কুমিরসহ বিভিন্ন প্রাণী আছে। দর্শনার্থীদের মধ্যে বানর আর হরিণকে খাবার খাওয়ানোর ধুম পড়ে গেল। চিড়িয়াখানা দেখা শেষে সামনে এগিয়ে একটা ওয়াচ টাওয়ার পেলাম। উঠতে না উঠতেই সেখান থেকে একটা বানর লাফ দিয়ে নিচে নামল। ওয়াচ টাওয়ারের ওপর থেকে অনেকক্ষণ ধরে করমজলের নয়নাভিরাম সুন্দরবন দেখলাম। জাহাজে ফিরে দুপুরের খাবার খেয়ে মংলা বন্দর। বিদায়ের পথে সুন্দরবনের দিকে তাকিয়ে থেকে মনটা এত খারাপ হয়ে গেল তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। বিদায় সুন্দরবন! তুমি ভালো থেকো, বাংলাদেশকে আগলে রেখো।
যাত্রা শুরুর গল্প
টানা হরতালের মধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের ক্লাস শুরু হলো মার্চের ২ তারিখ থেকে। এমন সময়ে একদিন প্রিয় বড় মামার ফোন! ফোন ধরতেই ভারী কণ্ঠে মামা বললেন, ‘বেড়াতে যাবি?’ আমি গোমড়া মুখে বললাম, ‘ক্লাস শুরু হয়ে গেছে, যেতে পারব না।’ কিন্তু মামার কথায় যখন জানতে পারলাম বেড়ানোর জায়গাটা সুন্দরবন! তখন তো আমার চোখ ছানাবড়া। সঙ্গে সঙ্গেই লাফিয়ে উঠে বলে দিলাম,‘মামা আমি রাজি।’ ফরিদপুরের কে এম কলেজ থেকে প্রতিবছরই শিক্ষক-শিক্ষিকা আর তাঁদের পরিবারের সদস্যদের জন্য একটা আনন্দ ভ্রমণের আয়োজন হয়। আমার বড় মামা মোসায়েদ হোসেন ঢালী এই কলেজের প্রিন্সিপাল। তাঁর সুবাদেই অতিথি হিসেবে আমিও জুটে গেলাম এবারের আনন্দভ্রমণে। মার্চের প্রথম সপ্তাহেই মামা-মামি আর মামাতো বোন চারুর সঙ্গে আমিও সুন্দরবনে যাত্রা করলাম। ফরিদপুর থেকে বাসে খুলনার রূপসা ঘাট। সেখান থেকে তিনতলা জাহাজে সুন্দরবন।
সকালে কোকিলমনি, বিকালে কটকা
ভোরবেলায় মামার ডাকে ঘুম ভাঙল। জাহাজের কেবিন থেকে বেরিয়েই আমি হতবাক। নদীর দুইপাড় ধরে যত দূর চোখ যায় সবুজের মেলা। এই সবুজ যেন খালি আরও কাছে ডাকে। কিছুক্ষণ জাহাজের রেলিঙে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ বিস্ময় তাকিয়ে থাকলাম। হঠাৎ পড়িমরি করে ছুটলাম ক্যামেরা আনতে। পটাপট ছবি তুলতে তুলতেই দেখলাম, অন্যরাও ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে গেছে। তবে কিছুক্ষণ পরই ছবি তোলার উৎসাহে ভাটা পড়ল। বুঝলাম, এ সৌন্দর্য ক্যামেরায় ধরে রাখা যায় না, এটা অনুভব করতে হয়।
রাতে ছোটখাটো একটা ঝড় হয়েছিল। তার জের ধরে সকাল থেকেই দফায় দফায় বৃষ্টি। আবহাওয়া খারাপ থাকায় আমরা হিরণ পয়েন্টে নামতে পারলাম না। শেষমেশ এগারোটা নাগাদ হালকা বৃষ্টির মধ্যে আমরা প্রথম স্পষ্ট হিসেবে কোকিলমনি ঘাটে নামলাম। জাহাজ থেকে ছোট ল্যাংবোটে করে আমাদের যেখানে নামিয়ে দেওয়া হল। কোকিলমনি খুব বড় জায়গা না। মাঝে বড় একটা দিঘি। আমাদের দলের অনেকেই সেখানে গোসল করলেন। বাকিদের ঘোরাঘুরি আশপাশে। আমার নজর কাড়ল দিঘির পাড়ে দুটি বড় নৌকা।
ঘোরাঘুরি শেষে আমরা জাহাজে ফিরলাম দুপুরের খাবার খেতে। খাওয়া-বিশ্রাম সেরে জাহাজ রওনা দিল কটকায়। কটকায় নেমেই বড় একটা কাঠের সাঁকো। সাঁকোতে দাঁড়িয়েই দেখলাম বনের মধ্যে ঝাঁকে ঝাঁকে হরিণ চড়ে বেড়াচ্ছে। কাছে যাওয়ার চেষ্টা করতেই হরিণগুলো দৌড়ে পালায়। চিত্রা হরিণের মায়াময় মুখ দেখে মনে হল আহা! যদি একটু কোলে নিয়ে আদর করতে পারতাম! কিন্তু তাই-কী সম্ভব? বনের হরিণ তো বনেই থাকবে। অগত্যা ছবি তুলেই মনকে শান্ত করার চেষ্টা করতে থাকলাম। বেলা ঘনিয়ে এলে এল ফেরার পালা। কটকায় একটা জিনিস খুব চোখে পড়ল। সেটা হচ্ছে অসংখ্য গাছের কাণ্ড থেকে ভাঙা, শুধু গোড়া পড়ে আছে। সঙ্গী বনরক্ষী আলিম মামা জানালেন, ওগুলো ঝড়ে উপড়ে গেছে। আমাদের দেশকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবল থেকে রক্ষায় সুন্দরবনের ভূমিকা যে কতখানি তা যেন নিজ চোখে দেখে এলাম।
রাতের বেলায় জাহাজের ছাদে উঠলাম। নদীর মৃদু বাতাস মনটাকেই অন্যরকম করে দিল। জাহাজে উঠেই আপন, অনীক, জীবন, রাকিবের মত আমার সমবয়সী কয়েকজনের সঙ্গে পরিচয় হয়ে গিয়েছিল। সবাই মিলে গানের আসর বসালাম। ধীরে ধীরে আরও অনেকে এসে যোগ দিল। চলল আনন্দ-আড্ডা গান। আড্ডা শেষে কেবিনে ফিরে ঘুম। কিন্তু বনপরীরা যেন সব ঘুম কেড়ে নিয়েছে আমার। ফ্ল্যাশব্যাকের মতো সারা দিনের সব দৃশ্য একের পর এক চোখের সামনে। ঘোরাঘুরির কথা চিন্তা করতে করতেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম।
জামতলা সৈকত ও কচিখালি
রাতেই জেনেছিলাম সকালের গন্তব্য জামতলা সমুদ্র সৈকত। সকাল নয়টা নাগাদ পৌঁছে গেলাম। জামতলা সৈকতে যেতে প্রায় আধঘণ্টা হাঁটতে হলো একদম বনের ভেতর দিয়েই। খানিকটা যে ভয় লাগছিল না তা নয়। কিন্তু শ্বাসমূল এড়িয়ে এড়িয়ে বনপথে হাঁটা এতটাই উপভোগ করলাম যে কিছুই যেন টের পেলাম না। সৈকতে পৌঁছেই শুরু হয়ে গেল লাফালাফি! বালিতে-পানিতে মাখামাখি। আর লাফালাফির একটার পর একটা ছবি তোলা তো চলছেই। ফেসবুকে দিতে হবে না!
দুপুর নাগাদ আমরা পৌঁছালাম কচিখালিতে। এই খানে নাকি ঝাঁকেঝাঁকে হরিণ দেখা যায়। কচি খালিতে নামার পর অবশ্য পুরো দলটাই দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেল। একদল আর সামনে এগোতে চায় না! আমরা কয়েকজন তরুণ সামনে এগোতে থাকলাম, একসময় দেখলাম বাকিরাও আমাদের পিছু নিয়েছে। একটু সামনে গিয়ে দেখি একি! এ তো হাজারে হাজারে হরিণ! কিন্তু দূরে আমাদের দেখেই হরিণগুলো সচকিত। ছুটন্ত হরিণের পাল দেখতে যে কী সুন্দর! মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলাম।
আরেকটু এগিয়ে আমরা একটা বড় পাকুড় গাছের নিচে বসলাম। বনরক্ষী আলিম মামা শুরু করলেন মানুষখেকো বাঘের রোমহর্ষক গল্প। ওনার গল্প বলার ভঙ্গিতেই কিনা জানি না, দিনের বেলাতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। একটা গল্প মনে বেশ দাগ কেটে গেল মনে। এক লোকের রাতে পানির খুব পিপাসা লাগল কিন্তু ঘরে পানি নেই। বউয়ের নিষেধ না মেনে সে গেল নদী থেকে পানি আনতে। হঠাৎ গগনবিদারী চিৎকার আর বাঘের গর্জনে পুরো এলাকা প্রকম্পিত। বউটি তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বের হয়ে আধো আলোছায়ার মধ্যেই দেখতে পেল-একটা বাঘ মুখে করে কিছু একটা ঝুলিয়ে নিয়ে নদী পার হচ্ছে! বউটির আর বুঝতে বাকি থাকল না যে, তাঁর বরকেই বাঘে খেয়েছে! সুন্দরবনের মানুষদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভাবতে ভাবতে মন খারাপ নিয়ে কচিখালি থেকে ফিরে এলাম।
আমার সাতপুরুষের ভাগ্য সেই রাতে পূর্ণিমা হলো। বনে চাঁদের অসহ্য সুন্দর নরম আলোয় মনে কী যেন এক হাহাকারের গান। খালের পানিতে চাঁদের আলো চিকচিক করছে। যাওয়ার পথে চিটা-কটকা নামে একটা খাল দিয়ে গিয়েছিলাম। সেই খালের মধ্যে দিয়ে সুন্দরবনকে আরও কাছ থেকে গভীরভাবে দেখা গিয়েছিল। ভেবেছিলাম সারা দিনের সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত বুঝি এইটাই। কিন্তু পূর্ণিমার আলো সব ভুলিয়ে দিল। আজ আর জাহাজের ছাদে নয়। জাহাজের পেছনে বাঁধা ল্যাংবোটে গিয়ে বসলাম। সেখানে বাতাস অনেক কম। অনেক ছবি তুললাম আমরা। একটু পর পলি আপু, চারুসহ আরও কয়েকজন আসায় আবার হালকা গলায় গানের আসর। জোছনার আলোয় বনের হালকা বাতাসে গানে গানে মনে হলো আহ! ধন্য এ মানব জীবন!
ফেরার দিনেও ঘোরাঘুরি
ফেরার দিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই মনে বিষাদ। জাহাজ ছুটছে আপন গতিতে। এই জাহাজ আরও কতবার এই পথ দিয়ে যাবে কিন্তু তাতে আমি থাকব না! বিষণ্নতা ঝেড়ে নাশতা করার জন্য নিচে নেমে জানলাম আমরা ফিরব ভিন্ন একটা পথে। প্রথম গন্তব্য হাড়বাড়িয়া। তারপর করমজল। ভ্রমণের শেষ স্পট হিসেবে বেলা এগারোটায় নামলাম করমজলে।
সুন্দরবনে হরিণ, কুমির, শূকর আর পাখ-পাখালি ছাড়া খুব বেশি প্রাণী দেখিনি। আর বাঘ মামা তো ধারেকাছেই আসলেন না! তাই মনে একটা দুঃখ ছিল। কিন্তু দুঃখ আরও বেড়ে গেল সুন্দরবনের ভেতরেই করমজলের চিড়িয়াখানা দেখে! সেখানে হরিণ, বানর, কুমিরসহ বিভিন্ন প্রাণী আছে। দর্শনার্থীদের মধ্যে বানর আর হরিণকে খাবার খাওয়ানোর ধুম পড়ে গেল। চিড়িয়াখানা দেখা শেষে সামনে এগিয়ে একটা ওয়াচ টাওয়ার পেলাম। উঠতে না উঠতেই সেখান থেকে একটা বানর লাফ দিয়ে নিচে নামল। ওয়াচ টাওয়ারের ওপর থেকে অনেকক্ষণ ধরে করমজলের নয়নাভিরাম সুন্দরবন দেখলাম। জাহাজে ফিরে দুপুরের খাবার খেয়ে মংলা বন্দর। বিদায়ের পথে সুন্দরবনের দিকে তাকিয়ে থেকে মনটা এত খারাপ হয়ে গেল তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। বিদায় সুন্দরবন! তুমি ভালো থেকো, বাংলাদেশকে আগলে রেখো।