গুপদীঘির
হাওরে টুপ করে ডুবে গেল সূর্যটা। আমরা তখন সবে মিঠামইনের কামালপুরে
রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে পেছনের ঘাটে বাঁধা নৌকার
দিকে যাচ্ছি। ক্যামেরা তাক করতে করতেই ডুবে গেল সূর্য। পাশ থেকে সঙ্গী
হাসান ইমামের গলা, ‘ভাইয়া, দেখেন দেখেন...।’ সামনে তাকাতেই দেখি
দিগন্তজুড়ে হাওরের পানি লালে লাল। একটু খেয়াল করতেই চোখে পড়ল আশ্চর্য এক
সূর্যাস্ত। আকাশে মেঘ ছিল। ডুবে যাওয়া সূর্যের লাল-সোনালি-হলুদ আলো লেজার
রশ্মির মতো একেকটা রেখা ছড়িয়ে পড়েছে আকাশজুড়ে। দূরে ইটভাটা আর
বৈদ্যুতিক খুঁটিগুলোর কালো কায়া এই সূর্যাস্তকে যেন আরও গাঢ় করে দিয়েছে।
বাদল মাঝির নৌকায় চেপে হাওর অঞ্চলে যে যাত্রা শুরু করেছিলাম ২৯ আগস্ট, সেই দিনই দেখা পাই এমন সূর্যাস্তের। সমুদ্রসহ ছোট-বড় অনেক নদীতেই দেখা হয়েছে সূর্যাস্ত, তবে ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের হাওর এলাকায় একেক দিন দেখেছি একেক রকম সূর্যাস্ত। হাওর এলাকার অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য হলো, প্রায় ছয় মাস সাতটি জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা থাকে জলমগ্ন। নদী-নালা, খালবিল, ধানী জমি—সবই থাকে পানির নিচে। নৌকা নিয়ে কোনাকুনি সরাসরি যাওয়া যায় এখানে-সেখানে।
দ্বিতীয় দিন মিঠামইন থেকে ইটনা হয়ে পৌঁছে যাই নেত্রকোনার খালিয়াজুরী উপজেলার কৃষ্ণপুর গ্রামে। এই গ্রামে থাকা হাওর অঞ্চলের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ দেখতে দেখতে বিকেল গড়িয়ে যেতে থাকে। সূর্যাস্ত দেখতে হবে, তাই দ্রুত পা বাড়াই ঘাটের দিকে। নৌকা চলল খালিয়াজুরী উপজেলা সদরের দিকে। হঠাৎই যেন সবকিছু শান্ত। বাতাস নেই, ছায়ার হাওরের পানিও যেন শান্ত। নৌকার বাবুর্চি সুমন চা দিয়ে গেছে। এই লাল চায়ের রংটা সূর্যাস্তের রঙের সঙ্গে মিলে যায়। ছায়ার হাওরের ইতিউতি হিজল-করচের ঝোপঝাড়ের ওপরে মেঘলা আকাশে তখন সূর্য ডোবার আয়োজন শুরু হয়েছে। আজ এর রংটা কোমল হলুদ-সোনালি। কখনো কখনো মেঘের কালো রেখা।
খালিয়াজুরী বাজার থেকে ৩১ আগস্ট নৌকা ছাড়ার পর থেকেই দূরে নীল পাহাড়, ঝাপসা। ঘণ্টা আড়াই পরে লেপসিয়া বাজার। এখানে নেত্রকোনা জেলার পাট চুকাল। দূরে নীল পাহাড়ের কোলে যে টাঙ্গুয়ার হাওর, সেটা
আমাদের গন্তব্য। পুরো দিনই আমাদের কাটল নীলে নীলে। বিলম্বিত বন্যার কারণে হাওরের পানি কিছুটা ঘোলা; কিন্তু শাপলা, খুদি পানা আর হিজল-করচে ভরা হাওরের পানি যেন অনেকটাই স্বচ্ছ শরতের আকাশ আর নীল পাহাড়ের প্রভাবে। মাঝখানে এক চিল যেন ভর করে ক্যামেরার লেন্সে। দক্ষ মডেলের মতো উড়ে উড়ে পোজ দেয় সে। বেলা তিনটার দিকে পৌঁছে যাই টাঙ্গুয়ার হাওরে। কানে ভেসে আসে বাদল মাঝির ফোনালাপ—‘বউ, এতু বড় পাহাড় আমি জীবনেই দেখি নাই।’
ফোন শেষ করে আমাদের বলেন, ‘চলেন, ওই পাহাড়ের গোড়াত যাইয়াম।’
‘ঠিক আছে, চলেন। তবে কেউ থামতে বললে আর আগাবেন না।’
কারণ পাহাড়গুলো ভারতের সীমানায়। মেঘালয়ের গারো পাহাড়। পাহাড়ের গোড়া ছুঁয়ে ধরি ফিরতি পথ। যাব সুনামগঞ্জের তাহিরপুর। টাঙ্গুয়ার হাওরে সূর্য ডুবছে পাহাড়ের উল্টোদিকে। ডুবন্ত সূর্য নিয়ে ক্যামেরার শাটারে ব্যস্ত আঙুল। কেন যেন মনে হলো—আচ্ছা, পাহাড়ের দিকে তাকাই তো! ঘুরে তাকাতেই দেখি নীল পাহাড়ের ডগায় তুলো তুলো মেঘদলে গোলাপি আভা। ক্লিক ক্লিক ক্লিক...। শাটার না টিপে তো উপায় নেই!
১ সেপ্টেম্বর যেন স্বপ্নের যাত্রা। তাহিরপুর থেকে সুনামগঞ্জের দিরাই। দিরাইয়ের উজানধল গ্রামে বাউল শাহ আবদুল করিমের বাড়ি। সেখানে যেতেই হবে। শনির হাওর হয়ে যেতে হয় দিরাই—জানা গেল এমনটাই। ঘণ্টা দুয়েক চলার পর আমরা পড়লাম সুরমা নদীতে। তারও কিছু পর পথ হারালাম। নেত্রকোনার লেপসিয়া বাজারের পর আর কোনো অভিজ্ঞতাই নেই আমাদের মাঝিদের। আর কয়েকটা নদী, হাওর-বিল পেরিয়ে দিরাই পুরাতন লঞ্চঘাটে পৌঁছালাম সন্ধ্যার আগে আগে। রিকশায় কলেজঘাট, এখানে বারারা বলদমারা বিল। ছোট একটা নৌকা নিয়ে আমরা চললাম কালনী নদীর দিকে, উজানধলের পানে। সময় তখন সন্ধ্যা ছুঁইছুঁই। বিলের পানিতে আরেকটি সূযাস্ত। ছোট ছোট গ্রামকে রাঙানো মায়াবি এক সূর্যাস্ত।
‘কী জাদু করিয়া বন্ধে
মায়া লাগাইছে
পিরিতি শিখাইছে
দেওয়ানা বানাইছে।’
সূর্যাস্তের এমন রূপ দেওয়ানা করার জন্য যথেষ্টই বটে।
২ সেপ্টেম্বর হাওরে শেষ সূর্যাস্ত। দিরাই থেকে হবিগঞ্চের আজমিরিগঞ্জ, লাখাই হয়ে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম। সূর্যাস্তের সময়টায় ঢুকে গেছি অষ্টগ্রাম উপজেলার হাওরে। এখানে সূর্য ডুবল জলে ভাসা ছোট ছোট গ্রামে। একেবারে টকটকে লাল। হঠাৎই পড়লাম খুদে খুদে পোকার খপ্পরে। অসংখ্য পোকা কানে ঢুকছে, নাকে ঢুকছে। স্থির থাকাই কষ্টকর। আর ওদিকে প্রকৃতি পুরোটাই লাল। নৌকা চলমান, গ্রামগুলোও চলছে। আর বড় থালাটাও ঝাপ দিচ্ছে হাওরের বিস্তৃত জলে। যেন পারফেক্ট ডাইভ।
বাদল মাঝির নৌকায় চেপে হাওর অঞ্চলে যে যাত্রা শুরু করেছিলাম ২৯ আগস্ট, সেই দিনই দেখা পাই এমন সূর্যাস্তের। সমুদ্রসহ ছোট-বড় অনেক নদীতেই দেখা হয়েছে সূর্যাস্ত, তবে ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের হাওর এলাকায় একেক দিন দেখেছি একেক রকম সূর্যাস্ত। হাওর এলাকার অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য হলো, প্রায় ছয় মাস সাতটি জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা থাকে জলমগ্ন। নদী-নালা, খালবিল, ধানী জমি—সবই থাকে পানির নিচে। নৌকা নিয়ে কোনাকুনি সরাসরি যাওয়া যায় এখানে-সেখানে।
দ্বিতীয় দিন মিঠামইন থেকে ইটনা হয়ে পৌঁছে যাই নেত্রকোনার খালিয়াজুরী উপজেলার কৃষ্ণপুর গ্রামে। এই গ্রামে থাকা হাওর অঞ্চলের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ দেখতে দেখতে বিকেল গড়িয়ে যেতে থাকে। সূর্যাস্ত দেখতে হবে, তাই দ্রুত পা বাড়াই ঘাটের দিকে। নৌকা চলল খালিয়াজুরী উপজেলা সদরের দিকে। হঠাৎই যেন সবকিছু শান্ত। বাতাস নেই, ছায়ার হাওরের পানিও যেন শান্ত। নৌকার বাবুর্চি সুমন চা দিয়ে গেছে। এই লাল চায়ের রংটা সূর্যাস্তের রঙের সঙ্গে মিলে যায়। ছায়ার হাওরের ইতিউতি হিজল-করচের ঝোপঝাড়ের ওপরে মেঘলা আকাশে তখন সূর্য ডোবার আয়োজন শুরু হয়েছে। আজ এর রংটা কোমল হলুদ-সোনালি। কখনো কখনো মেঘের কালো রেখা।
খালিয়াজুরী বাজার থেকে ৩১ আগস্ট নৌকা ছাড়ার পর থেকেই দূরে নীল পাহাড়, ঝাপসা। ঘণ্টা আড়াই পরে লেপসিয়া বাজার। এখানে নেত্রকোনা জেলার পাট চুকাল। দূরে নীল পাহাড়ের কোলে যে টাঙ্গুয়ার হাওর, সেটা
আমাদের গন্তব্য। পুরো দিনই আমাদের কাটল নীলে নীলে। বিলম্বিত বন্যার কারণে হাওরের পানি কিছুটা ঘোলা; কিন্তু শাপলা, খুদি পানা আর হিজল-করচে ভরা হাওরের পানি যেন অনেকটাই স্বচ্ছ শরতের আকাশ আর নীল পাহাড়ের প্রভাবে। মাঝখানে এক চিল যেন ভর করে ক্যামেরার লেন্সে। দক্ষ মডেলের মতো উড়ে উড়ে পোজ দেয় সে। বেলা তিনটার দিকে পৌঁছে যাই টাঙ্গুয়ার হাওরে। কানে ভেসে আসে বাদল মাঝির ফোনালাপ—‘বউ, এতু বড় পাহাড় আমি জীবনেই দেখি নাই।’
ফোন শেষ করে আমাদের বলেন, ‘চলেন, ওই পাহাড়ের গোড়াত যাইয়াম।’
‘ঠিক আছে, চলেন। তবে কেউ থামতে বললে আর আগাবেন না।’
কারণ পাহাড়গুলো ভারতের সীমানায়। মেঘালয়ের গারো পাহাড়। পাহাড়ের গোড়া ছুঁয়ে ধরি ফিরতি পথ। যাব সুনামগঞ্জের তাহিরপুর। টাঙ্গুয়ার হাওরে সূর্য ডুবছে পাহাড়ের উল্টোদিকে। ডুবন্ত সূর্য নিয়ে ক্যামেরার শাটারে ব্যস্ত আঙুল। কেন যেন মনে হলো—আচ্ছা, পাহাড়ের দিকে তাকাই তো! ঘুরে তাকাতেই দেখি নীল পাহাড়ের ডগায় তুলো তুলো মেঘদলে গোলাপি আভা। ক্লিক ক্লিক ক্লিক...। শাটার না টিপে তো উপায় নেই!
১ সেপ্টেম্বর যেন স্বপ্নের যাত্রা। তাহিরপুর থেকে সুনামগঞ্জের দিরাই। দিরাইয়ের উজানধল গ্রামে বাউল শাহ আবদুল করিমের বাড়ি। সেখানে যেতেই হবে। শনির হাওর হয়ে যেতে হয় দিরাই—জানা গেল এমনটাই। ঘণ্টা দুয়েক চলার পর আমরা পড়লাম সুরমা নদীতে। তারও কিছু পর পথ হারালাম। নেত্রকোনার লেপসিয়া বাজারের পর আর কোনো অভিজ্ঞতাই নেই আমাদের মাঝিদের। আর কয়েকটা নদী, হাওর-বিল পেরিয়ে দিরাই পুরাতন লঞ্চঘাটে পৌঁছালাম সন্ধ্যার আগে আগে। রিকশায় কলেজঘাট, এখানে বারারা বলদমারা বিল। ছোট একটা নৌকা নিয়ে আমরা চললাম কালনী নদীর দিকে, উজানধলের পানে। সময় তখন সন্ধ্যা ছুঁইছুঁই। বিলের পানিতে আরেকটি সূযাস্ত। ছোট ছোট গ্রামকে রাঙানো মায়াবি এক সূর্যাস্ত।
‘কী জাদু করিয়া বন্ধে
মায়া লাগাইছে
পিরিতি শিখাইছে
দেওয়ানা বানাইছে।’
সূর্যাস্তের এমন রূপ দেওয়ানা করার জন্য যথেষ্টই বটে।
২ সেপ্টেম্বর হাওরে শেষ সূর্যাস্ত। দিরাই থেকে হবিগঞ্চের আজমিরিগঞ্জ, লাখাই হয়ে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম। সূর্যাস্তের সময়টায় ঢুকে গেছি অষ্টগ্রাম উপজেলার হাওরে। এখানে সূর্য ডুবল জলে ভাসা ছোট ছোট গ্রামে। একেবারে টকটকে লাল। হঠাৎই পড়লাম খুদে খুদে পোকার খপ্পরে। অসংখ্য পোকা কানে ঢুকছে, নাকে ঢুকছে। স্থির থাকাই কষ্টকর। আর ওদিকে প্রকৃতি পুরোটাই লাল। নৌকা চলমান, গ্রামগুলোও চলছে। আর বড় থালাটাও ঝাপ দিচ্ছে হাওরের বিস্তৃত জলে। যেন পারফেক্ট ডাইভ।