সিলেটের পর্যটন মোটেলে কেবল ঘর বুঝে পেয়েছি, তখনই রয়েল পালের ফোন, ‘আজ কোথায় যাবেন?’
‘চলে আসেন মোটেলে। কথা বলি।’ বলে হাতের কাজগুলো শেষ করতে থাকি। সকাল আটটার দিকে শমসেরনগরের সুইস ভ্যালি রিসোর্ট থেকে যাত্রা শুরু। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে সিলেট শহরে পৌঁছে গিয়েছি। রাস্তায় ভিড় নেই। ঈদের পর সিলেট শহরের আয়েশি ভাবটা এখনো কাটেনি।
রয়েল সিলেটেরই ছেলে। ফেসবুকে পরিচয়। সিলেট যাচ্ছি জেনে ফেসবুকেই লিখেছিলেন, বিছনাকান্দি যাবেন।
টুর-প্ল্যান ঠিক করিনি তখনো। কিন্তু চারজনের দলের কনিষ্ঠ সদস্য দুজন, সনকা আর শৌনক বলছিল, রাতারগুল আর লালা খাল যেতেই হবে। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রয়েলের বিছনাকান্দি। দুই দিনেই সব ঘুরে দেখতে হবে।
পর্যটনের বর্ণালি রেস্তোরাঁয় চা খেতে খেতে রয়েল বলেন, ‘আজ যে সময়টুকু আছে, তাতে বিছনাকান্দি আর পান্তুমাই ঝরনা দেখা যাবে।’
তা-ই সই। বেরিয়ে পড়া গেল। চালকসহ আমরা পাঁচজন। ফলে ‘ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই, ছোট সে গাড়ি’। কিন্তু এই ছোট গাড়ির চালকের পাশের আসনটি রয়েল পেয়ে যান। পেছনে চাপাচাপি করে আমরা চারজন বসি। একজন সাচ্চা প্রকৃতিপ্রেমীকে সঙ্গে পেয়ে আমাদের ভ্রমণের আনন্দ ডানা মেলে।
রয়েল বলেছিলেন বিছনাকান্দির পানিতে স্নান করার কথা। বাড়তি কাপড় নিয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু সেখানে কাপড় পরিবর্তন করার সুযোগ নেই বলে আমরা তা বাতিল করে দিয়েছি। স্নান করতেই হবে, এমন কোনো কথা নেই। চোখে দেখার মূল্যও কম নয়।
পর্যটন মোটেলের পাহাড়ি পথ বেয়ে নেমে ডান দিকে ঘুরে বিমানবন্দরের আগেই ডান দিকে মোড় নিয়েছে যে রাস্তা, সেটা দিয়েই এগোই আমরা। শালুটিকর পার হয়ে যেতে হবে আমাদের। জানা আছে, গোয়াইনঘাটের পথে যেতে যেতে বঙ্গবীরে এসে বাঁ দিকে মোড় নিতে হবে।
শুরুটা যেমন-তেমন। শালুটিকরের কাছাকাছি যেতেই রাস্তাটা হঠাৎ খাল-বিল-নদী-নালার রূপ পেল। অগত্যা গাড়ি থেকে নেমে পড়তে হয়। হেঁটে হেঁটে কিছুটা পথ পার হই। ঠিক এমনভাবে ৪৫ কিলোমিটার পথে ১০ থেকে ১২ বার গাড়ি থেকে নামতে হয়। ঝক্কি শুধু এটুকুই। বাকিটা স্বপ্নের মতো!
সরু রাস্তার দুই পাশের সবুজ ধানখেত দেখতে দেখতে হঠাৎ যখন সুদূরের পাহাড়গুলো দৃশ্যমান হয়ে ওঠে, তখনই স্বপ্নের শুরু। আরে! আকাশটাও বদলে গেছে! উজ্জ্বল নীল আকাশ আর তার শরীরে সাদা মেঘ নানা ভঙ্গিমায় নৃত্যরত। পাহাড়ে এসে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছে মেঘ। দিগন্তরেখায় মেঘ আর পাহাড়ের পারস্পরিক ভালোবাসা দেখে চোখ জুড়ে যায়।
রয়েল আমাদের আশ্বস্ত করেন, পাহাড়ের যত কাছে যাবেন, ততই ভালো লাগবে।
বলে দিতে হবে না। আমাদের ভালো লাগতে শুরু করেছে। গোয়াইনঘাটের দিকে না গিয়ে আমরা যখন বাঁয়ের রাস্তায় বঙ্গবীর পয়েন্ট পেলাম, তখন থেকে রাস্তা হলো কিছুটা প্রশস্ত, মসৃণ। এ পথেই পৌঁছে যাই হাদার পাড়। পর্যটক ফারুখ আহমেদ বলে দিয়েছিলেন হাদার পাড়ে ভুনা খিচুড়ি খেতে। ভুনা খিচুড়ি মানে পোলাওর চাল দিয়ে তৈরি খিচুড়ি, সঙ্গে কিছুটা চানা আর একটা ছোট্ট পিয়াজু; ভালোই লাগে খেতে।
গাড়ি রেখে আমরা স্কুলঘরের ভেতর দিয়ে ঘাটের দিকে এগোই। ঘাটে অনেক মানুষ। নৌকা কম। তাই তিনটি দলের মোট ১৫ জন একটি নৌকায় উঠি। এক ঘণ্টা বিছনাকান্দিতে থাকব, এই শর্তে ভাড়া ঠিক হয় ৯০০ টাকা। ইঞ্জিন নৌকা চলতে শুরু করে, আমাদের স্বপ্নও সে পথ ধরে এগোয়। বহুদূরের পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝরনা দেখা যায়। পথে একজন হঠাৎ বলেন, ‘নৌকা ভেড়ান?’
ব্যাপার কী! খোলাসা হয়, এখানেই তাঁর মামাবাড়ি। তিনি নেমে যাওয়ার পর একজন রসিকতা করে বলেন, ‘মামারে সালাম দিয়েন আর দুপুরে রান্না কইরা রাখতে বইলেন। আমরা আজ আপনার মামাবাড়িতে লাঞ্চ করব।’
এই একটি কথাই নৌকায় থাকা প্রত্যেক মানুষকে হাসায়, উজ্জ্বীবিত করে। এরপর বাঁ দিকে বাঁক নেয় নৌকা। অনতি দূরে আমরা অনেক মানুষ দেখতে পাই, পাথর দেখতে পাই, বাঁধভাঙা ঢলের মতো জলস্রোত দেখতে পাই। আর তার ওপরে পাহাড় দেখতে পাই। আমাদের শরীর-মন চনমনে হয়ে ওঠে। বিছনাকান্দিকে নৌকা ভেড়ানোর পর যখন ঠান্ডা জলে প্রথম পা রাখি, মনে হয় বরফ-শীতল ভালোবাসা এসে স্পর্শ করল আমাদের। একটু একটু করে ঝরনার জলের কাছাকাছি হই। পায়ের নিচে শ্যাওলা জমা পাথরকে অগ্রাহ্য করে বালু কিংবা পরিষ্কার পাথর খঁুজি।
এর পরের ঘটনা বর্ণনাতীত। শুধু এটুকু বলতে পারি, কে কখন সেই ঝরনার জলে নিজেকে পুরোপুরি সঁপে দিয়েছেন, তা টেরই পাইনি আমরা। এক ঘণ্টারও বেশি সময় পাথরে মাথা রেখে সেই পানিতে শুয়ে থাকতে থাকতে মনে হলো, বিছনাকান্দি নামটা বোধ হয় এ কারণেই হয়েছে—জলে শয্যা!
মাঝির যদি ফিরে যাওয়ার তাড়া না থাকত, তাহলে আমরা হয়তো সেই জলেই শুয়ে থাকতাম আরও অনেকটা সময়। আমাদের ভালো লাগে, এখানকার প্রকৃতিতে মানুষের বন্য হামলা এখনো শুরু হয়নি। বাণিজ্য এসে গ্রাস করেনি এই ভূখণ্ডটিকে। দুর্গম পথই হয়তো শাপে বর হয়েছে।
এরপর রাতারগুল, লালা খালসহ বেশকিছু জায়গায় তো গেলাম। কিন্তু পাহাড়-মেঘ-আকাশের স্থিরচিত্রের নিচে প্রবহমান বিছনাকান্দির পাথরের বাধা পার হওয়া জলে অবগাহনের আনন্দের কাছে সব আনন্দই ম্লান হয়ে গেছে।
কীভাবে যাবেন
সিলেট বিমানবন্দরের পাশ দিয়ে যে রাস্তাটি, সেটি দিয়ে চলে যেতে হবে গোয়াইনঘাট রোডে। রেন্ট–এ–কার থেকে গাড়ি ভাড়া করতে পারেন। কিংবা সিএনজিচালিত অটোরিকশা বা লেগুনায় করেও যেতে পারেন। নিজের গাড়িতে গেলে তো কথাই নেই। শালুটিকর পার হয়ে সেতুর নিচ দিয়ে ডান দিকে ঘুরে গেলে গোয়াইনঘাটের দিকে একটাই রাস্তা। এই পথ ধরেই পৌঁছে যাবেন বঙ্গবীর পয়েন্টে। সেখান থেকে বাঁ দিকে বাঁক নিয়ে হাদার পাড়ে আসবেন। নৌকার ঘাট থেকে দুই বা তিন ঘণ্টার জন্য ইঞ্জিনচালিত নৌকা ভাড়া করবেন। ২০ মিনিটেই পৌঁছে যাবেন বিছনাকান্দি।