নৌকা ছাড়তেই চোখ জুড়িয়ে গেল, শরীরও জুড়াল হিমেল বাতাসে। যদিও তখন
দুপুর ১২টা। ২৯ আগস্ট কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর বাজার ঘাট থেকে শুরু হলো
জলযাত্রা। কালী নদীর কালো জল, শরতের নীল আকাশ, পুবালি বাতাসে ইঞ্জিন নৌকার
ভট ভট আওয়াজও আমাদের কানে যেন সুরেলা হয়ে ওঠে। ঘাটে বিদায় দেওয়ার সময়
বন্ধু কাউসার খান জানিয়ে দিয়েছেন কুলিয়ারচর হলো হাওর অঞ্চলের
গেটওয়ে—সিংহ দুয়ার। কালী নদী পেরোতে না-পেরোতে হাওরের দেখা পাই। চারদিকে
দিগন্তজুড়ে পানি—মাঝে ইতিউতি স্থল, একেকটা জনপদ। পানিমগ্ন ইটের ভাটা,
সাবমার্জ সড়ক ধরে বিদ্যুতের খুঁটি, আর নানা কিছিমের নৌযান দেখতে দেখতে
আমরা পড়ি জমশার হাওরে। হাওর-যাত্রার শুরু বলা যায়।
২৯ আগস্ট থেকে ৩ সেপেটম্বর পর্যন্ত নায়ে ভেসে ভেসে
বাংলাদেশের এই হাওর অঞ্চল দেখেছি। কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, সিলেট,
মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া—এই সাত জেলাজুড়ে বিস্তার হাওর
এলাকার। বছরের প্রায় ছয় মাস পুরো এলাকায় থইথই পানি। নদী, খালবিল, হাওর,
ফসলের খেত—পানিতে একাকার। নৌকা দিয়ে চলাচল করা যায় একেবারে কোনাকুনি। এ
সময়ে এই অঞ্চলের জীবনযাত্রা আমাদের নাগরিক চোখে নেহাতই অন্য রকম। ছয় দিন
ছয় রাতে হাওর এলাকার পাঁচ জেলার বেশ কয়েকটি উপজেলা ঘুরে তেমনটাই মনে
হয়। বর্ষার শুরুতেই হাওর এলাকায় পানি আসা শুরু করে। আগস্টের শেষ বা
সেপ্টেম্বরের প্রথমদিকে পানি নামা শুরু হয়। এ বছর আবার এ সময়টাতেই পানি
ছিল সর্বোচ্চ স্তরে। এই ভ্রমণের সময় দেখা হাওর এলাকার জীবনযাত্রা,
প্রকৃতির খণ্ড খণ্ড চিত্র নিয়ে এই লেখা।
রাষ্ট্রপতির বাড়ি২৯
আগস্ট দুপুরে নেমেছিলাম কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম। আবার চলা। বিকেলের দিকে
হঠাৎ চোখে পড়ল একটা স্থলভাগ, যেটার চারদিকে সবুজ। কাছে যেতে চেনা গেল
নারকেলগাছের সারি। এই বাঁকটা ঘুরলেই রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের বাড়ি।
মিঠামইন উপজেলার কামালপুর গ্রাম। সহযাত্রী হাসান ইমামকে নিয়ে নেমে পড়ি ডাঙায়। রাষ্ট্রপতির বাড়ির দুটো অংশের একটায় লেখা ‘হাজী তায়েব উদ্দিন’, রাষ্ট্রপতির বাবার নাম। পাশে হলুদ একতলা ঘরের বারান্দায় সিরামিকের তৈরি রাষ্ট্রপতির প্রতিকৃতি। বাড়ির চালের নিচে ইংরেজিতে লেখা আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেট। আমাদের দেখে এগিয়ে এলেন মতিউর রহমান মতিন। সম্পর্কে রাষ্ট্রপতির ভাতিজা। ‘চলেন, ভেতরটা দেখবেন।’ ফটক দিয়ে আমরা ঢুকলাম পরিপাটি এক উঠানে। মাঝখানে বড় নিমগাছ। উঠোনের চারদিকে কয়েকটা ঘর। একেকটা ঘর রাষ্ট্রপতির ভাই বা বোনের। ওপরে টিন দেওয়া ছোট্ট দোতলা ঘরটা দেখিয়ে মতিন বলেন, ‘উনি বাড়ি এলে এ ঘরেই থাকেন।’
মিঠামইন উপজেলার পুরোটাই হাওরবেষ্টিত। উপজেলা সদরে কোনো যানবাহন এমনকি রিকশাও চোখে পড়ে না। এনজিওকর্মী কেফায়েতুল্লাহ জানালেন, গাড়ি, বাস, ট্রাক দেখতে এখানকার মানুষ কিশোরগঞ্জে যান। কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে একটা বাঁশের ঝুড়িতে বসিয়ে সেই ঝুড়ি বাঁশে ঝুলিয়ে পালকির মতো দুজন কাঁধে করে হাসপাতালে নিয়ে যান।
মিঠামইন উপজেলার কামালপুর গ্রাম। সহযাত্রী হাসান ইমামকে নিয়ে নেমে পড়ি ডাঙায়। রাষ্ট্রপতির বাড়ির দুটো অংশের একটায় লেখা ‘হাজী তায়েব উদ্দিন’, রাষ্ট্রপতির বাবার নাম। পাশে হলুদ একতলা ঘরের বারান্দায় সিরামিকের তৈরি রাষ্ট্রপতির প্রতিকৃতি। বাড়ির চালের নিচে ইংরেজিতে লেখা আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেট। আমাদের দেখে এগিয়ে এলেন মতিউর রহমান মতিন। সম্পর্কে রাষ্ট্রপতির ভাতিজা। ‘চলেন, ভেতরটা দেখবেন।’ ফটক দিয়ে আমরা ঢুকলাম পরিপাটি এক উঠানে। মাঝখানে বড় নিমগাছ। উঠোনের চারদিকে কয়েকটা ঘর। একেকটা ঘর রাষ্ট্রপতির ভাই বা বোনের। ওপরে টিন দেওয়া ছোট্ট দোতলা ঘরটা দেখিয়ে মতিন বলেন, ‘উনি বাড়ি এলে এ ঘরেই থাকেন।’
মিঠামইন উপজেলার পুরোটাই হাওরবেষ্টিত। উপজেলা সদরে কোনো যানবাহন এমনকি রিকশাও চোখে পড়ে না। এনজিওকর্মী কেফায়েতুল্লাহ জানালেন, গাড়ি, বাস, ট্রাক দেখতে এখানকার মানুষ কিশোরগঞ্জে যান। কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে একটা বাঁশের ঝুড়িতে বসিয়ে সেই ঝুড়ি বাঁশে ঝুলিয়ে পালকির মতো দুজন কাঁধে করে হাসপাতালে নিয়ে যান।
ভাসমান শিক্ষাতরি৩০
আগস্ট ইটনা থেকে শাইন্যার বিল পেরোতেই চোখে পড়ে লাল-নীল রং করা বড় বড়
ঝাঁপ তোলা এক নৌকা। হাসান ইমামের নির্দেশে ওই নৌকার কাছে ভেড়ে আমাদের
নৌকা। কাছে যেতেই বোঝা গেল এটা আসলে একটা স্কুল। ব্র্যাকের শিক্ষাতরি।
কাছাকাছি গ্রামে এপাড়া-ওপাড়ার ঘাটে ভিড়ে ভিড়ে প্রতিদিন চলে প্রাথমিক
শ্রেণির পড়াশোনা। নৌকাতেই চট বিছিয়ে ক্লাসরুম। ব্ল্যাকবোর্ডসহ শিক্ষা
উপকরণও আছে। ইটনার সুভদ্রাপুর গ্রামের শিক্ষাতরিতে ৩০ জন ছেলেমেয়েকে
পড়াচ্ছিলেন ইতি রানী। জানালেন পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয় এই
নৌকায়।
পুরো হাওর এলাকায় এ রকম শিক্ষাতরি চোখে পড়েছে অনেকগুলো। দিরাইয়ের কাছে চোখে পড়ল প্রায় একই রকম নকশার সাদা একটা নৌকা। এটিও ব্র্যাকের। এ তরি হলো ‘ডেলিভারি সেন্টার’। বাচ্চা প্রসবের ব্যবস্থা রয়েছে নৌকায়।
পুরো হাওর এলাকায় এ রকম শিক্ষাতরি চোখে পড়েছে অনেকগুলো। দিরাইয়ের কাছে চোখে পড়ল প্রায় একই রকম নকশার সাদা একটা নৌকা। এটিও ব্র্যাকের। এ তরি হলো ‘ডেলিভারি সেন্টার’। বাচ্চা প্রসবের ব্যবস্থা রয়েছে নৌকায়।
টাঙ্গুয়ার হাওরে: খালিয়াজুরির
লেপসিয়া বাজার থেকে ৩১ আগস্ট নৌকা চলল উজান ঠেলে। আবছা পাহাড়, নীল আকাশে
মেঘের খেলা, নিচে প্রায় স্বচ্ছ পানি। চলেছি সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরের
দিকে। দুপুরের দিকে মূল হাওরে ঢুকে গেল নৌকা। মাঝেমধ্যে চিল, বক আর
পানকৌড়ি চোখে পড়ছে। নৌকার মাঝি বলে, ‘এত বড় পাহাড় দেখি নাই। চলেন
গোড়াদ যাই।’ ঘণ্টা খানেক চলার পর পাহাড়ের কাছে পৌঁছাতে পারি। ফিরে আসি
হাওরের হিজল-করচ বনের পাশ দিয়ে। পেছনে দিগন্ত বিস্তৃত নীল পাহাড়।
কবরস্থান: হাওর এলাকার জনপদগুলোয় খড়ের
গাদা, বাড়ি, দোকান—সব যেন একটি দ্বীপে গাদাগাদি করে রাখা। পানি থাকার
সময়টায় কেউ মারা গেলে তাকে দাফন করার জায়গাও সেখানে নেই। তাই বেশ
কয়েকটি গ্রামের মানুষের জন্য হাওরের মাঝখানে এমন কবরস্থান চোখে পড়ে।
ছবিটি হোমায়পুর গ্রাম, জমশার হাওর থেকে তোলা।
সৌরবিদ্যুৎ
হাওর এলাকার উপজেলাগুলোর কিছু কিছু জায়গায় পল্লী
বিদ্যুতের বিদ্যুৎ সরবরাহ আছে। তবে সে বিদ্যুৎ কখন আসে কখন যায়, সে এক
ধাঁধাঁই যেন। তাই বাজারগুলোতে সৌরবিদ্যুৎ বেশ জনপ্রিয়। আবার নৌকাতেও
আছে এই সৌরবিদ্যুৎ। হাওরের মধ্যে চিহ্নিত মাছ ধরার জায়গাগুলো পাহারা দিতে
যে নৌকা ব্যবহার করা হয়, সেগুলোর ছইয়ের ওপর সৌরবিদ্যুতের প্যানেলও চোখে
পড়ে। ছবিটি খালিয়াজুরি বাজারের ঘাটে তোলা।
এক ঘাটেতে রান্ধিবাড়ি আরেক ঘাটে খাই...
মাছ কিনেছি সুনামগঞ্জের দিরাইয়ের কালনী নদী থেকে, রান্না
হতে হতে নৌকা চলে এসেছে হবিগঞ্জের লাখাইয়ের কাছে। সেখানে দুপুরে খাওয়া।
রাতের খাবার কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামে। হাওর এলাকায় এভাবেই চলেছে
প্রতিদিনকার খাওয়া-দাওয়া। কাউসার খান কুলিয়ারচর থেকে ঠিক করে দিয়েছিলেন
বাদল মাঝির নৌকা। বাদলের সঙ্গে ইঞ্জিন ড্রাইভার বাতেন, বাবুর্চি সুমন আর
হেলপার শফিকুল। ১৫০ যাত্রী ধারণক্ষমতার নৌকায় আমরা সব মিলে মাত্র ছয়জন।
শিক্ষাগ্রাম কৃষ্ণপুরআগেই
তথ্যপ্রযুক্তিবিদ মোস্তাফা জব্বার বলেছিলেন, ‘আমার গ্রামে যেও।’ ৩০ আগস্ট
মিঠামইন থেকে ইটনা হয়ে আমরা চলি ছায়ার হাওরের দিকে। এ হাওরের তীরেই ছোট্ট
গ্রাম কৃষ্ণপুর, নেত্রকোনার খালিয়াজুরি উপজেলার একটি ইউনিয়ন। হাওর
ঘেঁষেই মেয়েদের স্কুল। ১৯৯৪ সালে মোস্তাফা জব্বার এটা প্রতিষ্ঠা করেন।
প্রধান শিক্ষক রুবি আক্তার সরকার জানালেন এসএসসিতে পাসের হার ৯৭ শতাংশ।
সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান কিবরিয়া জব্বার নিয়ে গেলেন হাজি আলী আকবর
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে। বললেন, ‘পুরো ভাটি অঞ্চলে এটি একমাত্র
বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ।’ অধ্যক্ষ মো. আবুল কালাম আজাদ জানালেন সমাজকর্ম,
বাংলা ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) পড়ানো হয় এ কলেজে। কলেজে
ছাত্রীদের থাকার হোস্টেলও আছে। জানা গেল, ১৯৮৬ সালে ১০ হাজার টাকা খরচে
তৈরি একটা টিনের ঘরে এ কলেজের শুরু হয়। তারপর গ্রামের সবার অংশগ্রহণে এ
কলেজ এখন দাঁড়িয়ে গেছে স্বমহিমায়। এই গ্রামে আরও আছে একটি হাইস্কুল ও
একটি আলিম মাদ্রাসা।
ভাটির প্রথম স্কুল
২ সেপ্টেম্বর সকালে সুনামগঞ্জের দিরাই থেকে নৌকা চলে
হবিগঞ্জের আজমিরিগঞ্জের দিকে। এখানে আছে ‘বিরাট স্কুল’। এটাই ভাটি অঞ্চলের
প্রথম হাইস্কুল। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৯৩০ সালে। পোশাকি নাম আজমিরিগঞ্জ এবিসি
পাইলট মডেল উচ্চবিদ্যালয়। বিরাট গ্রামে স্কুলের সামনে চলছে মডেল স্কুলের
নতুন ভবনের নির্মাণকাজ। শিক্ষক সুখেন চন্দ্র সূত্রধর জানালেন বিরাটের
জমিদার বিমলাচরণ রায় এ স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। স্কুলের ছাত্র জগৎ জ্যোতি
দাস, বীর উত্তম শহীদ হয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে