বাংলা চলচ্চিত্র এখন যাচ্ছে বিভিন্ন উৎসবে। থাকছে উৎসবের প্রতিযোগিতা বিভাগেও। জিতে আনছে পুরস্কার। বাংলা ভাষায় তৈরি ছবির ব্যাপারে বিশ্বের অনেক দর্শকের আগ্রহ তৈরি হয়েছে। তাঁদের কাছে পৌঁছানোর জন্য ছবিগুলোর সাবটাইটেল করতে হয়। আগে অনেক খরচ করে বিদেশ থেকে এই কাজটি করতে হতো। এখন প্রযুক্তির সহজলভ্যতার কারণে তা দেশেই সম্ভব হচ্ছে। একসময় আর্থিক কারণে অনেক ভালো ছবির সাবটাইটেল করা সম্ভব হয়নি। ফলে তা যেতে পারেনি বিশ্বের চলচ্চিত্রপ্রেমীদের কাছে। কেউ কেউ ছবির চিত্রনাট্য ইংরেজি ভাষান্তর করে পাঠানোর চেষ্টা করেছেন। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে কথা হলো চলচ্চিত্র নির্মাতা তানভীর মোকাম্মেলের সঙ্গে। আলোচনার বিষয়, ‘বাংলা ছবির সাবটাইটেল’। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মেহেদী মাসুদ।
বাংলা ভাষায় তৈরি ছবির সাবটাইটেল করার প্রয়োজন কবে উপলব্ধি হলো?
ঢাকায় পাকিস্তান যুগের আগে ব্রিটিশ আমলেও ছবি তৈরি হয়েছে। এই যেমন সুকুমারী, লাস্ট কিস। তখনকার নির্মিত ছবি বিদেশে তেমন যেত না। ফলে সাবটাইটেল করার প্রয়োজনীয়তাও উপলব্ধি হয়নি। সেটা শুরু হলো বলতে পারেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর।
সাবটাইটেল করতে গিয়ে ওই সময় নির্মাতারা কী ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন?
সমস্যা ছিল একাধিক। কোনো ছবির ইংরেজি সাবটাইটেল করা মানে আসলে ঠিক ইংরেজিতে আক্ষরিক অনুবাদ করা নয়। দরকার বাংলা বাক্যটির নির্যাসটা নিয়ে বিদেশি পাঠকদের জন্য ইংরেজিতে যতটা সম্ভব বোধগম্য করে সেটা অনুবাদ করা। এ কাজে দক্ষ লোকের অভাব ছিল এ দেশে। এখনো আছে। এ ছাড়া ছিল প্রযুক্তিগত সমস্যা।
বাংলাদেশের এফডিসিতে ছবির প্রিন্টে সাবটাইটেল লাগানোর কোনো প্রযুক্তি ছিল না। ফলে চলচ্চিত্র নির্মাতাদের বোম্বে গিয়ে সেটা করতে হতো। এই উপমহাদেশে কেবল বোম্বেতেই ভারত সরকারের ‘ন্যাশনাল ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন’ বা এনএফডিসিতে সাবটাইটেল করার ব্যবস্থা ছিল। তবে এদেশ থেকে ওদেশে গিয়ে ছবির সাবটাইটেল করতে বড় খরচ আর পাসপোর্ট-ভিসার ঝামেলা তো ছিলই। এ ছাড়া তখন কেবল ব্লকের মাধ্যমে সাবটাইটেল হতো। ফলে বানান বা বাক্য গঠনে কোনো একটা ভুল হলে সেটা শোধরানোর উপায় থাকত না। পরে অবশ্য এনএফডিসি লেজার পদ্ধতিতে সাবটাইটেল করার প্রযুক্তি যুক্ত করে। ফলে কাজটা সহজ হয়।
সরকারিভাবে ছবি সাবটাইটেল করার কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে?
বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের নিয়ম ছিল যে যদি বাংলাদেশের কোনো ছবি বিদেশের কোনো চলচ্চিত্র-উৎসবে প্রদর্শনের জন্য গৃহীত হয়, সে ক্ষেত্রে ওই ছবির সাবটাইটেলের অর্থ সরকার প্রদান করবে। আমি ঠিক জানি না যে নিয়মটা এখনো আছে কি না, কিংবা ঠিক কোন কোন ছবি এ ধরনের সরকারি সহায়তা পেয়েছে।
আমাদের এখানে অনেকগুলো ভালো মানের ছবি তৈরি হয়েছিল, যা সাবটাইটেল না করার কারণে বিশ্বের চলচ্চিত্রপ্রেমীদের কাছে পৌঁছাতে পারেনি। এমন কিছু ছবির নাম বলবেন?
কেবল সাবটাইটেল না করতে পারার কারণে বাংলাদেশের ছবি কোনো চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো যায়নি, এমনটি বোধ হয় খুব বেশি নেই। কারণ, সব গুরুত্বপূর্ণ উৎসবেই ছবির ইংরেজি টেক্সট পাঠালে তারা তাদের উদ্যোগে ভাষান্তর করে নেয়। আমার একাধিক ছবির ক্ষেত্রে এমনটি ঘটেছে। তবে আমার ছবি হুলিয়া আমন্ত্রণ পেয়েও ইউরোপের একটা উৎসবে দেখাতে পারিনি। কারণ, অর্থের অভাবে বোম্বে থেকে ছবির সাবটাইটেল করাতে পারিনি। আর ওই উৎসবে কেবল সাবটাইটেল প্রিন্টই গ্রহণযোগ্য ছিল।
প্রযুক্তির দিক থেকে সাবটাইটেল করার সুবিধা এখন কতটা সহজলভ্য?
এখন তো অনেক সহজ হয়েছে। আসলে সাবটাইটেলের কাজের কয়েকটি পর্ব আছে—ইংরেজিতে যথার্থ অনুবাদ করা, স্পটিং, সিম্যুলেশন আর ছবির প্রিন্টের শরীরে সাবটাইটেলগুলো বসানো। ডিজিটাল প্রযুক্তির ফলে এসব কাজ এখন অনেক সহজ হয়েছে। তবে তা ৩৫ মিমি. প্রযুক্তির ছবির ক্ষেত্রে। এখন তো ডিজিটাল প্রযুক্তিতে ছবি বেশি তৈরি হচ্ছে। ফলে সাবটাইটেল আপনি ঘরে বসে আপনার নিজের কম্পিউটারেই করতে পারেন। আপনাকে এখন আর কোথাও যেতে হবে না। কাজটা আসলেই বেশ সহজ হয়ে গেছে। ৩৫ মিমি. প্রযুক্তির ছবির প্রিন্টে সাবটাইটেল করতে আগে খরচ হতো দেড় থেকে দুই লাখ টাকা। আর ডিজিটাল প্রযুক্তির ছবির প্রিন্টে খরচ এখন নেই বললেই চলে।
বাংলাদেশের ছবির সাবটাইটেলের মান কতটা উন্নত?
তেমন উন্নত নয়। অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। অনেক সময় ইংরেজি অনুবাদেই সমস্যা থাকে। সাবটাইটেল ঠিক আক্ষরিক অনুবাদ নয়, এটা অনেকে বুঝতে পারেন না। তা ছাড়া সাবটাইটেলের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক কিছু বিধিবিধান রয়েছে। যেমন প্রতিটি কার্ডে দুই লাইনের মধ্যে, প্রতি লাইনে কিছু নির্দিষ্টসংখ্যক শব্দের মধ্যে, বক্তব্যটি তুলে ধরতে হয়। এটা অনেকেই ঠিক জানেন না। এগুলো কেবল অভিজ্ঞতার ব্যাপার। দু-একটা ছবির সাবটাইটেল করার পরই একজন বিষয়টা বুঝতে পারেন।
সাবটাইটেলের মান উন্নত করার জন্য কী ধরনের পদক্ষেপ এখনই নিতে হবে?
যথার্থ অনুবাদের ব্যাপারটি গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি ভাষা আর সংস্কৃতির কিছু নিজস্ব প্রকাশভঙ্গি রয়েছে। বাংলা ভাষারও রয়েছে, ইংরেজি ভাষারও রয়েছে। এই পার্থক্যগুলো বুঝতে পারেন এমন যোগ্য অনুবাদকের অভাব আমাদের দেশে রয়েছে, যাঁরা বক্তব্যের শুদ্ধতা বজায় রেখে, ইংরেজি ভাষাভাষীর কাছে বক্তব্যটা সরলভাবে তুলে ধরতে পারেন। আমাদের প্রথমেই দরকার কিছু দক্ষ অনুবাদকের। কেবল ইংরেজিতে কেন? ফরাসি, স্পেনীয়, জাপানি—এসব ভাষার অনুবাদকও আমাদের তৈরি করতে হবে। আর ডিজিটাল প্রযুক্তি আসার ফলে সাবটাইটেল করার কাজ এখন খুব সহজ হয়ে গেছে। তবে আন্তর্জাতিক রীতিনীতি অনুযায়ী সাবটাইটেলগুলো ছবির গায়ে যথার্থভাবে লাগানোর ব্যাপারে সবাইকে আরও মনোযোগী আর দক্ষ হতে হবে।