Traveller news - হামহামের উচ্ছ্বাসে...

পথের ক্লান্তি ভু​িলয়ে দেয় ঝরনার এই রূপ। ছবি: রাকিব কিশোর

     
‘শ্রীমঙ্গলের গহিন বনে নিশ্চুপ বসে বৃষ্টির গান শুনলে কেমন হয়?’ এবার পরিকল্পনাটা ছিল আমারই। কিন্তু রাকিব কিশোরের আবদার ভিন্ন। বৃষ্টির এই সময়ে হামহাম ঝরনাটা একবার না দেখলেই নয়...! অতঃপর দলবেঁধে হামহামের উদ্দেশে ছুট।

রাতের বাসে চেপে শ্রীমঙ্গল পৌঁছাতে প্রায় ভোর হয়ে গেল। তারপর রিসোর্টে ব্যাগ রেখে নাশতা সেরে সকাল-সকালই বেরিয়ে পড়লাম হামহামের উদ্দেশে। কারণ, সিএনজিচালিত অটোরিকশায় কলাবন গ্রাম পর্যন্ত যেতেই কেটে যাবে এক ঘণ্টার বেশি। কলাবনে পৌঁছে তো আমাদের চক্ষুচড়ক গাছ! কাঁচা রাস্তায় প্যাচপেচে কাদা। প্রচণ্ড পিচ্ছিল সে রাস্তায় যাত্রার প্রথম আছাড়টি খেলেন শখ করে সঙ্গী হওয়া অটোরিকশাওয়ালা মামা! ৪৫ মিনিট কাদার সঙ্গে যুদ্ধ করে অবশেষে পাওয়া গেল হামহাম ঝরনায় যাওয়ার মূল পথ। এখান থেকেই শুরু হবে আসল যাত্রা। বাঁশ হাতে আত্মবিশ্বাসী আটজন অভিযাত্রী প্রস্তুত হামহাম জয় করার জন্য। সঙ্গে দুজন গাইড।

পাহাড়ের শোভা দেখতে দেখতে হাঁটছি আমরা। দুপাশে নাম না-জানা বিভিন্ন গাছ। কিছু গাছ আবার হেলে পড়েছে পথের পুরোটাজুড়ে। গাছ সরিয়ে দিতেই রঙিন প্রজাপতি উড়ে যায় ব্যস্ত হয়ে। কোথাও আবার ঘন বাঁশবাগান। মাঝ দিয়ে পাহাড়ি পথটুকু খুঁজে বের করে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ দেখি আমি একা! তিনটি দলে ভাগ হয়ে গেছেন বাকি সদস্যরা। আমি মাঝখানে। সামনে-পেছনে কারোর কোনো খোঁজ নেই। কী আর করা। একাই হেঁটে চললাম। কিছুক্ষণ পর সঙ্গের এক গাইডকে পাওয়া গেল। আবার একসঙ্গে পথচলা শুরু।

কাদাভরা ঢাল, সরু এবড়োখেবড়ো রাস্তা আর বাঁশের সাঁকো পাড়ি দিতে দিতেই কেটে গেছে প্রায় দুই ঘণ্টা। ‘আর কতক্ষণ?’ ক্লান্ত প্রশ্নের জবাবে গাইড জানালেন, আর বেশি দূরে নয়। এর মধ্যে যাঁরা উল্টো দিক থেকে আসছেন, তাঁরা সবাই সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য নিরুৎসাহিত করছেন। সবার একটাই কথা, ‘আপু, আমরা ফিরে যাচ্ছি! আর যাবেন না। অসম্ভব খারাপ রাস্তা।’ কিন্তু হামহাম দেখার নেশা তখন চেপে বসেছে জোরেশোরে। ‘শোনা কথায় কান দিতে নেই’ নীতিতে এগিয়ে চললাম বাঁশে ভর দিয়ে। ততক্ষণে অবশ্য রাস্তা কী পরিমাণ দুর্গম হতে পারে সেটা একটু একটু করে বুঝতে শুরু করেছি আমিও। ভয়াবহ খাড়া পাহাড়ি পথ, নিয়মিত বৃষ্টিতে পিচ্ছিল ঢালু রাস্তা। সম্বল কেবল একটি বাঁশ।
সব মিলিয়ে প্রায় তিন ঘণ্টা হাঁটার পর এক জায়গায় এসে থমকে দাঁড়ালাম। যত দূর চোখ যায় রাস্তা ঢালু হতে হতে মিশে গেছে নিচে। পিচ্ছিল সরু সেই রাস্তার দুই পাশে গভীর খাদ। ‘আপা কি ফিরে যাবেন?’ গাইডের শুকনো মুখের প্রশ্নকে পাত্তা না দিয়ে অসীম সাহস নিয়ে সামনে পা বাড়িয়েই ফ্রিস্টাইলে আছাড় খেয়ে পড়লাম! গাইড ভাই অতি ব্যস্ত হয়ে আমাকে টেনে তুললেন। ‘আপা হাত দেন। আস্তে আস্তে দাঁড়ান। এইবার বাঁশ ধরেন।’ আমি বাঁশ ধরে দাঁড়াতেই ধড়াস আওয়াজ শুনে দেখি গাইড ভাই এবার চিত হয়ে পড়েছেন! ওই রাস্তাটুকু পাড়ি দিতে গিয়ে টপটপ করে ঘাম পড়ে ঘোলা হয়ে গেছে চশমার গ্লাস। নখ ভেঙে আঙুল হয়েছে ক্ষতবিক্ষত। সেই রাস্তাটুকু শেষ করে ঝিরিপথে নামতেই দেখি হাঁটু কেটে রক্তাক্ত, আমি টেরই পাইনি। মাত্র হামহাম দেখে ফিরে আসা একটি দলের চোখমুখে বিস্ময় তখন। এ বিস্ময়ের কারণ হচ্ছে সেদিন আমিসহ মাত্র তিনজন মেয়েই নাকি পেরেছিল শেষ পর্যন্ত আসতে। ‘আপা, আপনাকে স্যালুট!’ তাঁদের কথায় আত্মবিশ্বাসটা নিমেষে টনটনে হয়ে উঠল আবার।
পাহাড়ি শীতল জলে পা ডুবিয়ে আরও কিছুক্ষণ হাঁটার পর কানে ভেসে এল ঝরনার গান। খুব মিহি সুরে কেউ যেন বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে চলেছে একটানা। কলকল শব্দটি ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে টের পেতেই উত্তেজনা বাড়তে থাকল, হামহামের কাছাকাছি চলে এসেছি প্রায়। হামহামের সামনে পৌঁছেই দেখা পেলাম প্রিয় সঙ্গীদের। আমার চিন্তায় একেকজনের অবস্থা করুণ। অনুশোচনায় কাতর হাসান ভাইয়ের মুখ দেখে মনে হলো উনি নিজেই অর্ডার দিয়ে রাস্তা এমন ভয়ংকর বানিয়েছেন এবং সেই রাস্তা দিয়ে আমাকে আসতে বাধ্য করেছেন।
মজার ব্যাপার হচ্ছে তখনো হামহাম ঝরনা দেখার সুযোগই হয়নি!  ঠিকমতো পৌঁছেছি সেটা সঙ্গী-সাথিরা বিশ্বাস করার পর চোখ ফেরালাম ঝরনার দিকে। শান্ত বনের সব নির্জনতা ছাপিয়ে হামহামের বুনো উচ্ছ্বাস প্রতিধ্বনিত হচ্ছে পাথরে পাথরে। চিৎকার করতে হয় প্রকৃতির এই অবিশ্বাস্য রূপ দেখে! হ্যাঁ, চিৎকারই করেছিলাম—‘আমি হামহাম জয় করেছি!’
যেভাবে যাবেন
শ্রীমঙ্গল থেকে কলাবনপাড়া যেতে হবে। সিএনজিচালিত অটোরিকশাওয়ালাকে হামহামের কথা বললেই নিয়ে যাবে সেখানে। রিজার্ভ অটোরিকশায় যেতে-আসতে খরচ পড়বে এত হাজার ৩০০ থেকে এক হাজার ৫০০ টাকা। সেখান থেকে স্থানীয় গাইড সঙ্গে নিয়ে পাহাড়ি রাস্তায় তিন ঘণ্টা হাঁটলেই পৌঁছে যাবেন হামহাম ঝরনা। হামহামের মূল পথে যাত্রা শুরু করার আগে সঙ্গে কিছু শুকনা খাবার, পানি ও খাবার স্যালাইন নিয়ে নেবেন
-

Latest

Popular Posts

Popular Posts

Popular Posts