সাজেক ভ্যালিতে গেলে প্রথমেই মনে হবে, এ কোথায় এলাম! সমতল শেষ হয়ে যখন থেকে পাহাড়ের চড়াই-উতরাই শুরু, তখনই মনে হতে থাকে, পাল্টে যাচ্ছে চারপাশ, সবুজ যেন সব দিক থেকে এগিয়ে আসছে, ঘিরে ধরতে চাইছে আমাদের।
ঢাকা থেকে রাতের বাসে রওনা দিয়ে আমরা ভোরেই পৌঁছে গেলাম খাগড়াছড়ি। আমরা মানে পড়াশোনা শেষ করে সদ্য চাকরিতে ঢোকা ছয় বন্ধু। জানা ছিল, সাজেক যেতে হলে পাড়ি দিতে হবে আরও অনেকটা পথ। দীঘিনালা-বাঘাইছড়ি-কাসলং-মাসালং-সাজেক—এই হলো খাগড়াছড়ি থেকে সাজেক যাওয়ার পথ। তার মানে দীঘিনালা পর্যন্ত পৌঁছাতে হবে আগে। দীঘিনালার বোয়ালখালীতে এসে ঠিক করে নিতে হবে, কী করে বাকি পথের দিশা মিলবে। বোয়ালখালী বাজার থেকে চাঁদের গাড়ি অথবা মোটরসাইকেলে করে যেতে হবে।
মোটরসাইকেলই আমাদের পছন্দ। বাঘাইছড়ি সেনাক্যাম্পে রিপোর্ট করতে হলো। তারপর মোটরসাইকেলগুলো চলতে লাগল তো চলতেই লাগল। চলতে চলতেই পাল্টে যেতে লাগল আশপাশের দৃশ্যপট। ‘আঁকাবাঁকা সর্পিল পথ’—এমন বাক্য বহু অ্যাডভেঞ্চার বইতে পড়েছি। এবার মোটরসাইকেল থেকে চর্মচক্ষে দেখলাম সেই সর্পিল পথ। আর সেই পথ দিয়ে যেতে যেতে রোমাঞ্চিত হচ্ছিল মন। প্রায় ৬০ ডিগ্রি খাড়া ঢাল বেয়ে নিচে নামা, কিংবা ওপরে ওঠার সময় আমার মনে বদ্ধমূল ধারণা হলো, প্রকৃতি-সৃষ্ট এই রোলারকোস্টারের সঙ্গে মনুষ্য-সৃষ্ট রোলারকোস্টার কোনো দিনই জয়ী হতে পারবে না। আর চারপাশের অপার সৌন্দর্য? বর্ণনায় কি তার পরিচয় দেওয়া যায়, না সম্ভব?
প্রায় তিন ঘণ্টা মোটরসাইকেল চলার পর পৌঁছে গেলাম সাজেক ভ্যালি। আমরা পৌঁছলাম সেই জায়গাটিতে, যার একদিকে বাংলাদেশ, অন্যদিকে ভারত।
আমরা খাগড়াছড়ি থেকে উত্তর-পূর্ব দিকে চলে এসেছি। মূল সাজেক বলতে আসলে ‘রুইলুং’ আর ‘কংলাক’ নামের দুটি বসতিকে বোঝায়। সমতল ভূমি থেকে প্রায় এক হাজার ৮০০ ফুট উঁচুতে এই বসতি। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী পাংখোয়াদের বসতি এখানে। সাজেক সেনাক্যাম্প থেকে আরও তিন কিলোমিটার কাঁচা রাস্তা পাড়ি দিয়ে পৌঁছতে হয় কংলাক পাহাড়ে। এখানে উঠতে হলে মোটরসাইকেল নয়, স্রেফ নিজের পা দুটির ওপরই ভরসা রাখতে হবে। কংলাকপাড়ায় এসেই মন ভরে গেল। প্রতিটি বাড়ির সামনেই ফুলের গাছ। এমন পরিচ্ছন্ন গ্রাম খুব একটা দেখেছি বলে মনে পড়ে না। ফেরার পথে আমরা ১০ নম্বর পুলিশ ক্যাম্পের সামনে মোটরসাইকেল থামিয়ে ঝরনার কলস্রোতে মুগ্ধ হলাম। এই রাস্তাতেই সিজুক ১ ও ২ নামে আরও দুটি ঝরনা আছে, কিন্তু সময় কোথায়? আমাদের তো আবার আজই যেতে হবে আলুটিলায়। সে অনেক পথ পেরিয়ে আবার খাগড়াছড়ি এসে অন্য পথ ধরতে হবে!
এবার খাগড়াছড়ি থেকে বেবিট্যাক্সিতে করে আলুটিলার পথে আমরা। পথে চেঙ্গি অ্যাপার্টমেন্ট এলাকায় অপরাজিতা বৌদ্ধবিহারে ৩৭ ফুট উচ্চতায় চক্রমনি (হাজারি) বুদ্ধমূর্তি দেখে নিলাম। বিশাল এই মূর্তির শরীরজুড়ে ছোট ছোট অসংখ্য বুদ্ধমূর্তি! এবার আলুটিলা। টিপটিপ বৃষ্টির পানি ঝরছে। আমাদের মনে হচ্ছে, অপার্থিব কোনো জায়গায় যেন চলে এসেছি। স্থানীয় লোকজন আলুটিলাকে হাতাই মাকড় বা দেবতার গুহা বলে। ভেতরে অন্ধকার, তাই বাইরে থেকে মশাল নিয়ে ঢুকতে হলো। গুহার পিচ্ছিল পথে চলতে চলতে গা ছমছম করছিল। নিজেদের মনে হচ্ছিল আদিম যুগের গুহামানব অথবা গুপ্তধনের খোঁজে আসা দস্যু। ১৫ মিনিট ধরে হাঁটার পর গুহার অন্য প্রান্ত দিয়ে বেরিয়ে এলাম আমরা। এক দিনে খাগড়াছড়ির দুই রকম দুই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে নিজেদের জড়িয়ে ফিরে এলাম আমরা। আর হ্যাঁ, এই ভ্রমণ আমাদের মনকে করে তুলল চনমনে, যার রেশ থেকে গেল অফিসে যোগ দেওয়ার পরও।
থাকার ব্যবস্থামূলত সাজেকে কোনো থাকার ব্যবস্থা নেই। খাগড়াছড়ি শহরে কিছু নতুন থাকার ভালো হোটেল রয়েছে। দীঘিনালায়ও থাকতে পারেন, সেখানে একটাই গেস্টহাউস আছে। দীঘিনালা থেকে কিছু শুকনো খাবার ও পানি সঙ্গে নিয়ে নেবেন, কারণ পুরো রাস্তায় কোনো দোকান নেই।