সুখে
থাকলে ভূতে কিলায়, আমাদেরও মনে অনেক সুখ ছিল, বগালেক থেকে চেনা রাস্তায়
হেঁটে হেঁটে পাড়ি জমাচ্ছিলাম কেওক্রাডাং হয়ে ওই সুদূরে তাজিনডং পাহাড়ের
দিকে। পথিমধ্যে দার্জিলিং পাড়ায় এসে স্থানীয় এক পাহাড়ির কথা শুনে
মাথায় রোমাঞ্চের ভূত চাপল, মাথার ঠিক এক হাত ওপরের ধবধবে সাদা মেঘ ফেলে
চোখ ছুটে গেল অচেনা পাহাড়ি জঙ্গলের গাছের িভড়ে, হাতছানি দিয়ে ডাকছে
আমাদের দুরের ঘন-জঙ্গল। সেদিকে নাকি ‘লুংথাউসি’ নামক এক মেঘ-বৃষ্টির পাড়া
আছে, সে পাড়ার নিচ দিয়ে অনেক দূর হেঁটে গেলে আছে এক অদ্ভুত পাহাড়ি ঝরনা,
নাম তার ‘জিংসাম সাইতার’।
কথা শেষ না হতেই। তাকিয়ে দেখি আমাদের দলের জুনায়েদ আর আরমান ভাই টিং টিং করে লাফিয়ে নেমে গেছে দার্জিলিং পাড়ার বাঁ-পাশ ধরে সবুজ ঘাস বিছানো অন্ধকার বুনোপথ ধরে। তাদের পিছে পিছে ঘন গাছের অন্ধকারে সানগ্লাস পরে নামা শুরু করলেন হাসান ভাই, এই পাহাড়ি পথে উষ্ঠা খাওয়ার উদ্বোধন শুরু হলো তাঁকে দিয়েই। পাহাড়ে ওপরে ওঠার চেয়ে নিচে নামা কঠিন, আর সেই সময়ে যদি পায়ের নিচে থাকে ঝুরঝুরে মাটি তাহলে আর দেখতে হবে না! প্রায় ৮০ ডিগ্রি কোণ ধরে একটানা ২০০০ ফুট খাড়া নামতে থাকলাম আমরা, পরিস্থিতি এমন যে পা একটু পিছলালেই সোজা পড়ব নিচে নামতে থাকা সঙ্গীর ঘাড়ে। এরপরে আবার ওঠা, আমাদের দুঃখ দেখে আকাশও কেঁদে দিল! পরিস্থিতি মুহূর্তেই পরিণত হলো রণাঙ্গনে। টানা আট ঘণ্টা বৃষ্টিতে সৃষ্ট পাহািড় ঢল ঠেলে আর শরীর ভর্তি গোটা ৭০-৮০টা জোঁক নিয়ে শেষ বিকেলে আমরা যখন লুংথাউসি পাড়ার সীমানায় পা রাখলাম তখন আর এতটুকু শক্তিও অবশিষ্ট রাখেনি খেয়ািল সবুজ পাহাড়। আমাদের দেখেই বেড়া বানানোর কাজ ফেলে ছুটে এলেন পাড়ার প্রধান লালমিং বম, ধরাধরি করে একেকজনকে শুইয়ে দিলেন সবুজ পাহাড়ে ঘেরা লুংথাউসির টুকটুকে লালমাটির জমিতে। আদর-আপ্যায়নের কমতি ছিল না এতটুকুও। তখনো আমরা জানতাম না যে চোখ বুজেছিলাম মেঘের রাজ্যে! বুঝলাম যখন সকাল হলো। রাতে থাকার জন্য চারটা তাঁবু টানিয়েছিলাম, সেগুলো ভিজে জবজবে, চারপাশে তাকিয়ে দেখি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পায়ের নিচ থেকে মেঘেরা কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠে যাচ্ছে ওপরের দিকে, যেন এইমাত্র তাদের স্কুল ছুটি হলো।
এরপর ‘মারফা’ খেত ডিঙিয়ে, বাঁশের ঝাড় মাড়িয়ে, বুনো ময়না পাখি উড়িয়ে গলাসম ঘাসে পিছলে পিছলে নামতে থাকলাম যেন জগতের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর অভিযানে। টানা দেড় ঘণ্টা নামার পর নিজেদের আবিষ্কার করলাম টলটলে জলের এক পাথুরে ঝিরিতে। সে ঝিরিপথের দুধার থেকে গলগল করে নামছে বৃষ্টির পানি, পাহাড়ি মাটি ধুয়ে নামা এই পানিতে এখন ময়লার বিন্দুমাত্র লেশও নেই, হাঁটুপানিতে নেমেই আঁজলা ভরে মুখে দিয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুললাম দুচোখ বন্ধ করে। আকাশসম উঁচু দুপাশের পাহাড়ের মাঝে গুটি গুটি পায়ে হাঁটতে থাকা নিজেদের নিতান্তই ক্ষুদ্র প্রাণী মনে হচ্ছে। কোথাও হাঁটুসম পানি আবার কোথাও কোমরসম। জায়গায়-বেজায়গায় গলা পর্যন্ত এসেও ঠেকেছে। সে পানিকে হাতের ধাক্কায় ঠেলেঠুলে আমরা যখন বাঁকের পর বাঁক পেরোচ্ছি তখনি একের পর এক ছোট ছোট পাহািড় ঝরনারা দল বেঁধে সামনে চলে আসছে। ক্রমাগত পানির শব্দ যেন পুরো জঙ্গলে ছড়িয়ে দিয়েছে সুরের এক মায়াজাল। প্রায় তিন ঘণ্টা পাথুরে ঝিরিতে হেঁটে অবশেষে আমরা পৌঁছালাম জিংসাম সাইতার ঝরনাতে।
একটা বিশাল পাহাড়ের ঠিক দুই পাশ দিয়ে সমানতালে একনাগাড়ে পড়ছে ধবধবে সাদা ঠান্ডা পাহাড়ি ধারা। তার সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে হলেও সাহস লাগে ধরাধমের এই দোপেয়ে জাতির। ঝমঝম শব্দে গড়িয়ে পড়া অদ্ভুত সুন্দর এই ঝরনার নামকরণ করা হয়েছিলো নাকি পাহাড়ি এক মেয়ের নামে, তার নাম ‘জিংসাম’, কোনো একসময় এই ঝরনার ওপরে পানি নিতে আসার সময় সে পা পিছলে পড়ে মারা যায় প্রায় দেড় শ ফুট নিচের পাথুরে জলের জমিতে। তার নাম অনুসারেই স্থানীয়রা এই ঝরনার নাম রাখেন জিংসাম সাইতার, পাহাড়ি ভাষায় ‘সাইতার’ মানে ঝরনা।
ঝরনাজলে জোঁকের সঙ্গে যখন আমরা গোসলে ব্যস্ত ততক্ষণে আকাশের আলো কমে গেছে, ঝরনার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আকাশ থেকেও নামছে বৃষ্টির ফোঁটা, পুরো জঙ্গল ঝাঁপিয়ে নামছে জলের বান। এমন রোমহর্ষক পাহাড় আমি কখনো বান্দরবানে দেখিনি, দেখিনি এমন অসহ্য সুন্দর সবুজও, সবকিছু ছাপিয়ে জিংসামের বিশালতা মুগ্ধ করে রেখেছিল আমাদের ছোট্ট এই দলের সব সদস্যকে। দিন শেষে আমরা যখন দূর পাহাড়ের মেঘের দিকে যাত্রা করেছি তখনো বারবার পেছন ফিরে দেখেছি জলের একটানা নাচন। আর মনে মনে ভেবে রেখেছি এই ঝরনাপাড়েই এক রাতে তাঁবু গেড়ে ঘুমাতে হবে। ঝিরঝির পানির শব্দের সঙ্গে চোখ মেলতে হবে জোনাকির মিছিলে...
আমরা গিয়েছিলাম আগস্ট মাসে। এখনো পানি আছে এখানে। জানুয়ারি থেকে মার্চ অবশ্য ঝরনা শুকনা থাকে।
যেভাবে যাবেনবান্দরবান থেকে সোজা রুমা বাজারের গাড়িতে উঠে চলে আসবেন বগালেক, সেখান থেকে পায়ে হেঁটে পাসিংপাড়া হয়ে নেমে যাবেন রুমনাপাড়ায়। স্থানীয় এক গাইড নিয়ে এরপর দিনের আলোকে বিদায় জানিয়ে ঢুকে পড়বেন মেঘ পাহাড়ের দেশের জঙ্গল অংশটুকুতে। এরপর শুধু হাঁটাপথ, ক্লান্তিহীন এই পথের শেষ প্রান্তে পেয়ে যাবেন পাহাড় ডিঙিয়ে ছুটে আসা অবাধ্য সুন্দর জিংসাম সাইতারকে।
কথা শেষ না হতেই। তাকিয়ে দেখি আমাদের দলের জুনায়েদ আর আরমান ভাই টিং টিং করে লাফিয়ে নেমে গেছে দার্জিলিং পাড়ার বাঁ-পাশ ধরে সবুজ ঘাস বিছানো অন্ধকার বুনোপথ ধরে। তাদের পিছে পিছে ঘন গাছের অন্ধকারে সানগ্লাস পরে নামা শুরু করলেন হাসান ভাই, এই পাহাড়ি পথে উষ্ঠা খাওয়ার উদ্বোধন শুরু হলো তাঁকে দিয়েই। পাহাড়ে ওপরে ওঠার চেয়ে নিচে নামা কঠিন, আর সেই সময়ে যদি পায়ের নিচে থাকে ঝুরঝুরে মাটি তাহলে আর দেখতে হবে না! প্রায় ৮০ ডিগ্রি কোণ ধরে একটানা ২০০০ ফুট খাড়া নামতে থাকলাম আমরা, পরিস্থিতি এমন যে পা একটু পিছলালেই সোজা পড়ব নিচে নামতে থাকা সঙ্গীর ঘাড়ে। এরপরে আবার ওঠা, আমাদের দুঃখ দেখে আকাশও কেঁদে দিল! পরিস্থিতি মুহূর্তেই পরিণত হলো রণাঙ্গনে। টানা আট ঘণ্টা বৃষ্টিতে সৃষ্ট পাহািড় ঢল ঠেলে আর শরীর ভর্তি গোটা ৭০-৮০টা জোঁক নিয়ে শেষ বিকেলে আমরা যখন লুংথাউসি পাড়ার সীমানায় পা রাখলাম তখন আর এতটুকু শক্তিও অবশিষ্ট রাখেনি খেয়ািল সবুজ পাহাড়। আমাদের দেখেই বেড়া বানানোর কাজ ফেলে ছুটে এলেন পাড়ার প্রধান লালমিং বম, ধরাধরি করে একেকজনকে শুইয়ে দিলেন সবুজ পাহাড়ে ঘেরা লুংথাউসির টুকটুকে লালমাটির জমিতে। আদর-আপ্যায়নের কমতি ছিল না এতটুকুও। তখনো আমরা জানতাম না যে চোখ বুজেছিলাম মেঘের রাজ্যে! বুঝলাম যখন সকাল হলো। রাতে থাকার জন্য চারটা তাঁবু টানিয়েছিলাম, সেগুলো ভিজে জবজবে, চারপাশে তাকিয়ে দেখি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পায়ের নিচ থেকে মেঘেরা কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠে যাচ্ছে ওপরের দিকে, যেন এইমাত্র তাদের স্কুল ছুটি হলো।
এরপর ‘মারফা’ খেত ডিঙিয়ে, বাঁশের ঝাড় মাড়িয়ে, বুনো ময়না পাখি উড়িয়ে গলাসম ঘাসে পিছলে পিছলে নামতে থাকলাম যেন জগতের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর অভিযানে। টানা দেড় ঘণ্টা নামার পর নিজেদের আবিষ্কার করলাম টলটলে জলের এক পাথুরে ঝিরিতে। সে ঝিরিপথের দুধার থেকে গলগল করে নামছে বৃষ্টির পানি, পাহাড়ি মাটি ধুয়ে নামা এই পানিতে এখন ময়লার বিন্দুমাত্র লেশও নেই, হাঁটুপানিতে নেমেই আঁজলা ভরে মুখে দিয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুললাম দুচোখ বন্ধ করে। আকাশসম উঁচু দুপাশের পাহাড়ের মাঝে গুটি গুটি পায়ে হাঁটতে থাকা নিজেদের নিতান্তই ক্ষুদ্র প্রাণী মনে হচ্ছে। কোথাও হাঁটুসম পানি আবার কোথাও কোমরসম। জায়গায়-বেজায়গায় গলা পর্যন্ত এসেও ঠেকেছে। সে পানিকে হাতের ধাক্কায় ঠেলেঠুলে আমরা যখন বাঁকের পর বাঁক পেরোচ্ছি তখনি একের পর এক ছোট ছোট পাহািড় ঝরনারা দল বেঁধে সামনে চলে আসছে। ক্রমাগত পানির শব্দ যেন পুরো জঙ্গলে ছড়িয়ে দিয়েছে সুরের এক মায়াজাল। প্রায় তিন ঘণ্টা পাথুরে ঝিরিতে হেঁটে অবশেষে আমরা পৌঁছালাম জিংসাম সাইতার ঝরনাতে।
একটা বিশাল পাহাড়ের ঠিক দুই পাশ দিয়ে সমানতালে একনাগাড়ে পড়ছে ধবধবে সাদা ঠান্ডা পাহাড়ি ধারা। তার সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে হলেও সাহস লাগে ধরাধমের এই দোপেয়ে জাতির। ঝমঝম শব্দে গড়িয়ে পড়া অদ্ভুত সুন্দর এই ঝরনার নামকরণ করা হয়েছিলো নাকি পাহাড়ি এক মেয়ের নামে, তার নাম ‘জিংসাম’, কোনো একসময় এই ঝরনার ওপরে পানি নিতে আসার সময় সে পা পিছলে পড়ে মারা যায় প্রায় দেড় শ ফুট নিচের পাথুরে জলের জমিতে। তার নাম অনুসারেই স্থানীয়রা এই ঝরনার নাম রাখেন জিংসাম সাইতার, পাহাড়ি ভাষায় ‘সাইতার’ মানে ঝরনা।
ঝরনাজলে জোঁকের সঙ্গে যখন আমরা গোসলে ব্যস্ত ততক্ষণে আকাশের আলো কমে গেছে, ঝরনার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আকাশ থেকেও নামছে বৃষ্টির ফোঁটা, পুরো জঙ্গল ঝাঁপিয়ে নামছে জলের বান। এমন রোমহর্ষক পাহাড় আমি কখনো বান্দরবানে দেখিনি, দেখিনি এমন অসহ্য সুন্দর সবুজও, সবকিছু ছাপিয়ে জিংসামের বিশালতা মুগ্ধ করে রেখেছিল আমাদের ছোট্ট এই দলের সব সদস্যকে। দিন শেষে আমরা যখন দূর পাহাড়ের মেঘের দিকে যাত্রা করেছি তখনো বারবার পেছন ফিরে দেখেছি জলের একটানা নাচন। আর মনে মনে ভেবে রেখেছি এই ঝরনাপাড়েই এক রাতে তাঁবু গেড়ে ঘুমাতে হবে। ঝিরঝির পানির শব্দের সঙ্গে চোখ মেলতে হবে জোনাকির মিছিলে...
আমরা গিয়েছিলাম আগস্ট মাসে। এখনো পানি আছে এখানে। জানুয়ারি থেকে মার্চ অবশ্য ঝরনা শুকনা থাকে।
যেভাবে যাবেনবান্দরবান থেকে সোজা রুমা বাজারের গাড়িতে উঠে চলে আসবেন বগালেক, সেখান থেকে পায়ে হেঁটে পাসিংপাড়া হয়ে নেমে যাবেন রুমনাপাড়ায়। স্থানীয় এক গাইড নিয়ে এরপর দিনের আলোকে বিদায় জানিয়ে ঢুকে পড়বেন মেঘ পাহাড়ের দেশের জঙ্গল অংশটুকুতে। এরপর শুধু হাঁটাপথ, ক্লান্তিহীন এই পথের শেষ প্রান্তে পেয়ে যাবেন পাহাড় ডিঙিয়ে ছুটে আসা অবাধ্য সুন্দর জিংসাম সাইতারকে।