আকাশে
মেঘ ছিল, বৃষ্টি ছিল না। ভাপসা গরম ছিল, বাতাস ছিল না। এমনি এক আবহাওয়ার
মাঝে আমাদের ফুরামন অভিযান শুরু হলো সাপছড়ি থেকে। রাঙামাটি শহরের বনরূপা
বাজার থেকে বেরোতেই বেলা গেল ঢলে। এখানকার সবচেয়ে উঁচু পাহাড়চূড়ায় ওঠার
এ অভিযাত্রায় আমার সঙ্গী ইশান দেওয়ান। তবলছড়ির চাকমা এ ছেলের সঙ্গে
ফুরামনে ওঠার দারুণ এক অনুপ্রেরণা পেলাম। সাপছড়ি থেকে ঘণ্টা দেড়েক হাঁটার
পর ফুরামন পাহাড়ের মূল অংশে উঠে পড়লাম আমরা। ক্রমে যতই ওপরে উঠতে
থাকলাম, কাপ্তাই লেক, রাঙামাটি শহর আর চারদিকের নির্জন পাহাড়ি এলাকা
দুচোখের সামনে উদ্ভাসিত হতে লাগল অপরূপ শোভা নিয়ে।
এ বছরের শুরুর দিকে একবার ফুরামন চূড়ায় উঠেছিলাম। তবে সময়টা শীতকাল থাকায় মনটা ভরাতে পারেনি ফুরামন। বর্ষাকালে এই পাহাড় চূড়ায় উঠে চারদিকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখার নাকি মজাই আলাদা! দূরের কাপ্তাই লেক পাহাড়ের মাঝে নীলাভ জলরাশি নিয়ে নীরবে গিয়ে যায় সম্প্রীতির গান। রাঙামাটি শহরটিও যেন লেকের মাঝে ছড়ায় সৌন্দর্যের মুক্তা। আর দূরের পাহাড়ের ভাঁজগুলো টেনে ধরে দুচোখের চাহনি। বছর পাঁচেক আগের ঘটনা। প্রথমবারের মতো সেবার যাই লেক-পাহাড়ের শহর রাঙামাটি। শুভলং থেকে ফেরার পথে কাপ্তাইলেকে এসে আমার দু’চোখ আটকে যায় ফুরামনের চূড়ায়। কী জাদুকরি দহরম-মহরম মেঘের সঙ্গে তার! মেঘের দল অনুপম মায়ায় আলতো করে আদর করে যায় ফুরামনের চূড়া। দেখে বিস্ময়ের শেষ ছিল না আমার! তখন অবশ্য ফুরামনের সঙ্গে পরিচয় হয়নি আমার। নামও জানতাম না তার।
বছর খানেক আগে ফটোসাংবাদিক ছন্দসেন চাকমার কাছে এ পাহাড়ের খোঁজ পাই। তারপর এক শীতের রাতে বেরিয়ে পড়ি রাঙামাটির উদ্দেশে। মানিকছড়ি থেকে জগদীশ চাকমা ও হৃত্বিক কালাই আমার সঙ্গে যোগ দেন। সেবারের যাত্রা ছিল সাপছড়ি থেকে পায়ে হাঁটার ট্রেইল ধরে। ফুরামনে ওঠার কয়েকটা পথ আছে। এবার ট্রেকিংয়ের সময়টা বর্ষাকাল থাকায় গাড়ি ওঠার পথটাকেই বেছে নিতে হলো। এখানে জানিয়ে রাখা ভালো, যাঁরা ট্রেকিংয়ের জন্য শুধু বান্দরবানকে আদর্শ জায়গা বিবেচনা করেন, তাঁদের ফুরামন দেবে নতুন বৈচিত্র্যের স্বাদ।
বর্ষাকালে পাহাড়ের গাছপালা আর জঙ্গলগুলো সজীব-সতেজ। রাস্তার পাশের সেগুনগাছের বড় বড় পাতা বাতাসের সঙ্গে দোল খেয়ে দারুণ পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। শীতকালে আবার এসব সেগুনগাছ পাতাবিহীন ন্যাড়া কঙ্কালের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। শুধু সেগুনগাছ কেন, পাহাড়গুলোই তো হয়ে পড়ে মলিন-বিবর্ণ। বিকেল বেলায় সাঁঝের ঝিঁঝি পোকার মতো নানা কীটপতঙ্গের গান শোনা যায়। এ যেন অন্য এক দুনিয়া।
ফুরামনের একেবারে চূড়ায় গৌতম বুদ্ধের মূর্তি। আর পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে ধ্যানঘর। এ পাহাড়েই অবস্থিত আন্তর্জাতিক বনবিহার ভাবনাকেন্দ্র। বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর কাছে সাপছড়িতে অবস্থিত বিশাল আকারের এ পাহাড়ের গুরুত্ব অনেক। পর্যটকেরা আসেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের টানে, চূড়ার ওপর থেকে কাপ্তাই লেকের নৈসর্গিক রূপে হাবুডুবু খেতে। চাকমা ভাষায় ফুরামন শব্দের অর্থ শেষ পাহাড়। অর্থাৎ সবচেয়ে উঁচু চূড়া। রাঙামাটি সদর উপজেলার এটিই সবচেয়ে উঁচু পাহাড়। অবশ্য এর উচ্চতা নিয়ে আছে দ্বিমত। কেউ বলেন, ফুরামনের উচ্চতা এক হাজার ৮০০ ফুটের বেশি হবে না। তবে দুই হাজার ফুট উচ্চতা টিংকু ট্রাভেলারের জিপিএসে ধরা পড়ে।
গাড়ি ওঠার রাস্তার শেষ প্রান্তে পেয়ে গেলাম কিয়োং অর্থাৎ বনবিহার। সেখানে আছে একটা প্রার্থনাঘর। কঠিন চীবরদানের সময় এই জায়গাটা বেশ জমে ওঠে। এখানে আছে পাঁচ থেকে ছয়টি ধ্যানঘর। যেগুলোর কোনোটি পাহাড়ের পাদদেশে, কোনোটি আবার পাহাড়ের মাথায়। কিয়োং ছেড়ে আরও কিছুটা নিচে নামলে পাওয়া যায় রন্ধনশালা।
কিয়োং চূড়ায় ওঠার বাকি পথের পুরোটাই সিঁড়ি। মিনিট বিশেক লাগে এ সিঁড়িপথে। গাইড ইশান দেওয়ান সিঁড়ি গুনে ৩৮২টি সিঁড়ি থাকার কথা জানালেন। ফুরামনের চূড়ার পরিসর খুব বেশি না। এখান থেকে পুরো দুনিয়াটাই যেন চোখের সামনে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। ভাসমান মেঘের সঙ্গে পাহাড়ের লুকোচুরি খেলা দেখার যেন এটাই উত্তম জায়গা। কাপ্তাই লেক আর আট-দশ কিলোমিটার দূরের রাঙামাটি শহরটিকে বেশ কাছেই বলে মনে হয় এই চূড়া থেকে। বরকল, নানিয়ারচর, জুরাইছড়ি আর কাপ্তাই উপজেলার পাহাড়ের ভাঁজগুলো হাতছানি দিয়ে ডাকে নান্দনিক রূপ নিয়ে। এমনকি বহু দূরের কর্ণফুলী নদীও এখান থেকে স্পষ্টভাবে দেখা যায়।
রাঙামাটি শহর ও কাপ্তাইলেকের অবস্থান ফুরামনের পূর্ব দিকে। তাই এখানকার সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে দুপুরের পর ট্রেকিং করা ভালো। আর খুব সকালে পৌঁছতে পারলে মেঘ-পাহাড়ের অনুপম সম্পর্ক উপভোগ করা যায় অনায়াসে।
সূর্যের তেজ কমে এল ক্রমেই। আর আমাদের ফেরার তাড়নাও বাড়ল সেই সঙ্গে। ফেরার পথেই নেমে এল গৌধূলির আলো, তারপর অন্ধকার। কীটপতঙ্গের গুঞ্জন সন্ধ্যার নীরবতা ভেঙে দিয়ে পাহাড়ি পথে আমাদের চলার গতিতে এনে দিল বেগ।
যেভাবে যাবেন
ঢাকার কলাবাগান, কমলাপুর ও ফকিরাপুল থেকে এস আলম, হানিফ, শ্যামলী, সেন্টমার্টিন পরিবহন, ডলফিনসহ বেশ কিছু পরিবহনে রাঙামাটি যাওয়া যায়। ফুরামনে যেতে হলে মানিকছড়িতে নামা ভালো। শহরে নামলে পুনরায় মানিকছড়ি আসতে হবে অটোরিকশায়। ট্রেকিং করতে চাইলে সঙ্গে একজন গাইড নিয়ে সদলবলে বেরিয়ে পড়ুন। আর গাড়িতে যেতে চাইলে রিজার্ভ করুন। চাঁদের গাড়ি বা জিপ কেবল মানিকছড়িতেই পাওয়া যায়। ভাড়া দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা।
এ বছরের শুরুর দিকে একবার ফুরামন চূড়ায় উঠেছিলাম। তবে সময়টা শীতকাল থাকায় মনটা ভরাতে পারেনি ফুরামন। বর্ষাকালে এই পাহাড় চূড়ায় উঠে চারদিকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখার নাকি মজাই আলাদা! দূরের কাপ্তাই লেক পাহাড়ের মাঝে নীলাভ জলরাশি নিয়ে নীরবে গিয়ে যায় সম্প্রীতির গান। রাঙামাটি শহরটিও যেন লেকের মাঝে ছড়ায় সৌন্দর্যের মুক্তা। আর দূরের পাহাড়ের ভাঁজগুলো টেনে ধরে দুচোখের চাহনি। বছর পাঁচেক আগের ঘটনা। প্রথমবারের মতো সেবার যাই লেক-পাহাড়ের শহর রাঙামাটি। শুভলং থেকে ফেরার পথে কাপ্তাইলেকে এসে আমার দু’চোখ আটকে যায় ফুরামনের চূড়ায়। কী জাদুকরি দহরম-মহরম মেঘের সঙ্গে তার! মেঘের দল অনুপম মায়ায় আলতো করে আদর করে যায় ফুরামনের চূড়া। দেখে বিস্ময়ের শেষ ছিল না আমার! তখন অবশ্য ফুরামনের সঙ্গে পরিচয় হয়নি আমার। নামও জানতাম না তার।
বছর খানেক আগে ফটোসাংবাদিক ছন্দসেন চাকমার কাছে এ পাহাড়ের খোঁজ পাই। তারপর এক শীতের রাতে বেরিয়ে পড়ি রাঙামাটির উদ্দেশে। মানিকছড়ি থেকে জগদীশ চাকমা ও হৃত্বিক কালাই আমার সঙ্গে যোগ দেন। সেবারের যাত্রা ছিল সাপছড়ি থেকে পায়ে হাঁটার ট্রেইল ধরে। ফুরামনে ওঠার কয়েকটা পথ আছে। এবার ট্রেকিংয়ের সময়টা বর্ষাকাল থাকায় গাড়ি ওঠার পথটাকেই বেছে নিতে হলো। এখানে জানিয়ে রাখা ভালো, যাঁরা ট্রেকিংয়ের জন্য শুধু বান্দরবানকে আদর্শ জায়গা বিবেচনা করেন, তাঁদের ফুরামন দেবে নতুন বৈচিত্র্যের স্বাদ।
বর্ষাকালে পাহাড়ের গাছপালা আর জঙ্গলগুলো সজীব-সতেজ। রাস্তার পাশের সেগুনগাছের বড় বড় পাতা বাতাসের সঙ্গে দোল খেয়ে দারুণ পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। শীতকালে আবার এসব সেগুনগাছ পাতাবিহীন ন্যাড়া কঙ্কালের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। শুধু সেগুনগাছ কেন, পাহাড়গুলোই তো হয়ে পড়ে মলিন-বিবর্ণ। বিকেল বেলায় সাঁঝের ঝিঁঝি পোকার মতো নানা কীটপতঙ্গের গান শোনা যায়। এ যেন অন্য এক দুনিয়া।
ফুরামনের একেবারে চূড়ায় গৌতম বুদ্ধের মূর্তি। আর পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে ধ্যানঘর। এ পাহাড়েই অবস্থিত আন্তর্জাতিক বনবিহার ভাবনাকেন্দ্র। বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর কাছে সাপছড়িতে অবস্থিত বিশাল আকারের এ পাহাড়ের গুরুত্ব অনেক। পর্যটকেরা আসেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের টানে, চূড়ার ওপর থেকে কাপ্তাই লেকের নৈসর্গিক রূপে হাবুডুবু খেতে। চাকমা ভাষায় ফুরামন শব্দের অর্থ শেষ পাহাড়। অর্থাৎ সবচেয়ে উঁচু চূড়া। রাঙামাটি সদর উপজেলার এটিই সবচেয়ে উঁচু পাহাড়। অবশ্য এর উচ্চতা নিয়ে আছে দ্বিমত। কেউ বলেন, ফুরামনের উচ্চতা এক হাজার ৮০০ ফুটের বেশি হবে না। তবে দুই হাজার ফুট উচ্চতা টিংকু ট্রাভেলারের জিপিএসে ধরা পড়ে।
গাড়ি ওঠার রাস্তার শেষ প্রান্তে পেয়ে গেলাম কিয়োং অর্থাৎ বনবিহার। সেখানে আছে একটা প্রার্থনাঘর। কঠিন চীবরদানের সময় এই জায়গাটা বেশ জমে ওঠে। এখানে আছে পাঁচ থেকে ছয়টি ধ্যানঘর। যেগুলোর কোনোটি পাহাড়ের পাদদেশে, কোনোটি আবার পাহাড়ের মাথায়। কিয়োং ছেড়ে আরও কিছুটা নিচে নামলে পাওয়া যায় রন্ধনশালা।
কিয়োং চূড়ায় ওঠার বাকি পথের পুরোটাই সিঁড়ি। মিনিট বিশেক লাগে এ সিঁড়িপথে। গাইড ইশান দেওয়ান সিঁড়ি গুনে ৩৮২টি সিঁড়ি থাকার কথা জানালেন। ফুরামনের চূড়ার পরিসর খুব বেশি না। এখান থেকে পুরো দুনিয়াটাই যেন চোখের সামনে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। ভাসমান মেঘের সঙ্গে পাহাড়ের লুকোচুরি খেলা দেখার যেন এটাই উত্তম জায়গা। কাপ্তাই লেক আর আট-দশ কিলোমিটার দূরের রাঙামাটি শহরটিকে বেশ কাছেই বলে মনে হয় এই চূড়া থেকে। বরকল, নানিয়ারচর, জুরাইছড়ি আর কাপ্তাই উপজেলার পাহাড়ের ভাঁজগুলো হাতছানি দিয়ে ডাকে নান্দনিক রূপ নিয়ে। এমনকি বহু দূরের কর্ণফুলী নদীও এখান থেকে স্পষ্টভাবে দেখা যায়।
রাঙামাটি শহর ও কাপ্তাইলেকের অবস্থান ফুরামনের পূর্ব দিকে। তাই এখানকার সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে দুপুরের পর ট্রেকিং করা ভালো। আর খুব সকালে পৌঁছতে পারলে মেঘ-পাহাড়ের অনুপম সম্পর্ক উপভোগ করা যায় অনায়াসে।
সূর্যের তেজ কমে এল ক্রমেই। আর আমাদের ফেরার তাড়নাও বাড়ল সেই সঙ্গে। ফেরার পথেই নেমে এল গৌধূলির আলো, তারপর অন্ধকার। কীটপতঙ্গের গুঞ্জন সন্ধ্যার নীরবতা ভেঙে দিয়ে পাহাড়ি পথে আমাদের চলার গতিতে এনে দিল বেগ।
যেভাবে যাবেন
ঢাকার কলাবাগান, কমলাপুর ও ফকিরাপুল থেকে এস আলম, হানিফ, শ্যামলী, সেন্টমার্টিন পরিবহন, ডলফিনসহ বেশ কিছু পরিবহনে রাঙামাটি যাওয়া যায়। ফুরামনে যেতে হলে মানিকছড়িতে নামা ভালো। শহরে নামলে পুনরায় মানিকছড়ি আসতে হবে অটোরিকশায়। ট্রেকিং করতে চাইলে সঙ্গে একজন গাইড নিয়ে সদলবলে বেরিয়ে পড়ুন। আর গাড়িতে যেতে চাইলে রিজার্ভ করুন। চাঁদের গাড়ি বা জিপ কেবল মানিকছড়িতেই পাওয়া যায়। ভাড়া দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা।