National news - স্বপ্নটা লুকিয়ে রেখেছিলেন মাহমুদউল্লাহ

অনেক তৃষিত প্রহর কেটেছে এ মুহূর্তটির জন্য। নিজের অভিষেক সেঞ্চুরি, তাও বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম—মাহমুদউল্লাহর উদ্‌যাপনে আনন্দ-স্বস্তি মিশে একাকার l শামসুল হক
বিশ্বকাপে আসার আগে কতজন কত স্বপ্নের কথা বলে এসেছেন। মাহমুদউল্লাহ কিছু বলেননি। স্বপ্নটা তিনি নিজের মনেই লুকিয়ে রেখেছিলেন। সেটি বললেন স্বপ্নপূরণের পর, ‘হ্যাঁ, আমারও স্বপ্ন ছিল বিশ্বকাপে বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম সেঞ্চুরিটা আমিই করব। তবে সেটি কাউকে বলিনি।’
এমনিতেই একটু অন্তর্মুখী স্বভাবের। এটা একটা কারণ। আরেকটা কারণ বোধ হয়, বাংলাদেশ দলে যাঁদের ঘিরে তারকাদ্যুতি খেলা করে, তিনি সেই দলে পড়েন না। তাঁর স্বপ্নের কথা শুনে কেউ যদি হেসে ফেলে, এমন ভয়ও কি ছিল মাহমুদউল্লাহর মনে!
নিজেই একটু ভেবে দেখুন না! বিশ্বকাপে বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম সেঞ্চুরিয়ান কে হতে পারেন, এই প্রশ্ন করলে আপনি কী বলতেন। হয়তো তামিম ইকবাল, হয়তো সাকিব বা মুশফিক, এমনকি এনামুলের কথাও বলে ফেলতে পারতেন অনেকে। মাহমুদউল্লাহ নামটা কারও মুখে উচ্চারিত হতো বলে মনে হয় না।
প্রচলিত অর্থে তারকা নন, এটাই একমাত্র কারণ নয়। ওয়ানডেতে যাঁর কোনো সেঞ্চুরিই নেই, তাঁর ব্যাটেই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম সেঞ্চুরির কথা কীভাবে ভাববেন! মাহমুদউল্লাহ ভেবেছিলেন, কিন্তু কাউকে বলেননি। ওয়ানডেতে প্রথম সেঞ্চুরি, বিশ্বকাপে বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম সেঞ্চুরি—মাহমুদউল্লাহর ব্যক্তিগত এসব অর্জনে বাড়তি মহিমা যোগ হলো উপলক্ষটার কারণে। বাংলাদেশের সামনে কোয়ার্টার ফাইনালের স্বপ্নের দরজাটাও যে খুলে দিল এই সেঞ্চুরি। সংবাদ সম্মেলনে এক সাংবাদিক তাই প্রশ্ন করলেন, এটা বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে অন্যতম সেরা ইনিংস কি না। মাহমুদউল্লাহর কাছ থেকে প্রত্যাশিত উত্তরটাই পাওয়া গেল, ‘এটা তো আমি বলতে পারব না। তবে আমি যত দিন খেলব, এই ইনিংসটা আমার কাছে বিশেষ কিছুই হয়ে থাকবে।’
তাঁর ব্যাটিংয়ে একটা পেলবতা আছে। চোখের জন্য প্রশান্তি আছে। মানুষ মাহমুদউল্লাহর সঙ্গেও সেটি খুব মানিয়ে যায়। গত এক-দেড় বছর সমালোচনার তিরে ক্ষতবিক্ষত হতে হয়েছে তাঁকে। মুশফিকুরের সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্কের কারণে কত কিছুই না শুনতে হয়েছে! এই সেঞ্চুরির পর সেসবের জবাব দেওয়ার মোক্ষম সুযোগটা তিনি কেন ছাড়বেন? অন্য কেউ হলে হয়তো ছাড়তেনও না, কিন্তু মাহমুদউল্লাহর ওসবে বিশ্বাস নেই। ‘ওই সময়টা খুব কঠিন ছিল’ বলে উল্টো তা থেকে ইতিবাচক কিছু খুঁজে বের করার চেষ্টা করলেন, ‘অনেক কিছু দেখেছি, অনেক কিছু শিখেছি। ওই সময়টা আমার জন্য বরং কাজেই এসেছে।’
সব সময় অন্যদের ছায়ায় ঢাকা পড়ে থাকা নিয়েও তাঁর কোনো আক্ষেপ নেই। বরং বললেন, ‘সাকিব-তামিম-মুশফিক-মাশরাফি ভাই অনেক দিন ধরে খেলছেন। ওনারা ম্যাচ উইনার। আমার ভূমিকা ছিল যতটুকু পারি দলে অবদান রাখার। নিচের দিকে ব্যাটিং করতাম। এখন ওপরে ব্যাটিং করার সুযোগ পেয়েছি, চেষ্টা করব যাতে আরও জয়ের নায়ক হতে পারি।’
গত বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচসেরা স্বীকৃতি পাননি, তবে শফিউলকে সঙ্গে নিয়ে তিনিই জয়ের বন্দরে ভিড়িয়েছিলেন বাংলাদেশের তরি। কাল সেঞ্চুরির পর তাঁর উদ্যাপন নিয়ে সবার কৌতূহল ছিল। মাহমুদউল্লাহ সেই কৌতূহলও মেটালেন, ‘আমার স্ত্রী আর ছেলে মাঠে আসেনি। হোটেলে টেলিভিশনে খেলা দেখছিল। আমি ওদের একটা ‘ফ্লাইং কিস’ দিয়েছি।’ সেঞ্চুরির পর স্ত্রী-পুত্রকে মনে পড়েছে আর মাকে মনে পড়েছে ম্যাচ শুরুর আগেই। যখন জাতীয় সংগীত বাজছে, ‘মা তোর বদনখানি মলিন হলে আমি নয়নজলে ভাসি’ মাহমুদউল্লাহর চোখের সামনে ভাসিয়ে তুলেছে মায়ের মুখ। ‘ওই লাইনটা গাইবার সময় মাকে খুব মনে পড়ছিল। অনেক দিন যে তাঁকে দেখি না।’
তাঁর সেঞ্চুরির সময় উইকেটে ছিলেন মুশফিকুর রহিম। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের পক্ষে দ্বিতীয় সেঞ্চুরিটাও প্রায় করেই ফেলেছিলেন। মুশফিকের ব্যাটিংয়ের অকুণ্ঠ প্রশংসা করলেন, ম্যাচটা জেতানোর জন্য বিশেষ ধন্যবাদ দিলেন পেসারদের। নিজের ইনিংস নিয়েই বরং সবচেয়ে মিতবাক। সেটির যা প্রাপ্য, সেটি দেওয়ার দায়িত্বটা নিজের কাঁধে তুলে নিলেন অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা। এটিকে তাঁর দেখা বাংলাদেশের কোনো ব্যাটসম্যানের সেরা ইনিংস বলেই থামলেন না, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেই তাঁর দেখা অন্যতম সেরা ইনিংসের স্বীকৃতি দিয়ে দিলেন মাহমুদউল্লাহর সেঞ্চুরিকে। যখন নেমেছেন, ৮ রানে ২ উইকেট হারিয়ে বাংলাদেশ কাঁপছে। এই বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো বল দারুণ সুইং করাচ্ছেন অ্যান্ডারসন। এত বড় প্রশংসার কারণ হিসেবে এসবও মনে করিয়ে দিলেন মাশরাফি।
পাশে বসে থাকা মাহমুদউল্লাহর মুখে তখন লাজুক হাসি। এই বিশ্বকাপ সামনে রেখে অনেক কষ্ট করেছেন। ওজন কমিয়েছেন প্রায় ১০ কেজি। মিষ্টি খেতে খুব ভালোবাসেন। শুধু নিজেকে আরও ফিট করে তুলতে গত ছয় মাস মিষ্টি মুখে দেননি। একটা হাসি দিয়ে বললেন, ‘ট্রেনারকে বলে রেখেছি, এই বিশ্বকাপ শেষে টানা সাত দিন বিরিয়ানি খাব। মিষ্টি খাব।’
বিশ্বকাপ শেষে কেন? কাল অন্তত মাহমুদউল্লাহকে একটু মিষ্টিমুখ করানো উচিতই ছিল!
-

Latest

Popular Posts

Popular Posts

Popular Posts