অয়ন
চক্রবর্তী। পশ্চিমবাংলার একটি স্যাটেলাইট চ্যানেলের কর্তাব্যক্তি।
চলচ্চিত্র নির্মাণ বা সিনেমাটোগ্রাফিতে নিজের ধারণা, শিক্ষা ও প্রজ্ঞা
অনেকদিনের হলেও দীর্ঘদিন পরই নির্মাণে এলেন তিনি। প্রথমবারের মতো চলচ্চিত্র
নির্মাণ করছেন তিনি। ছবির নাম ‘ষড়রিপু’। যে ছবিতে চিরঞ্জিত, ইন্দ্রনীল,
রজতাভ দত্ত’র সাথে কাজ করছেন আমাদের দেশের অভিনেত্রী সোহানা সাবা। ছবিটির
পাশাপাশি এই টেলিফোনে দীর্ঘ আড্ডার বিষয় ছিল টলিউডে আমাদের নায়িকাযোগ ও দুই
বাংলার চলচ্চিত্রের সহাবস্থানের সুখ-দুঃখ।ছবিগুলো তুলেছেন অদিতি রায়।
কেমন
আছেন?-এমন প্রশ্ন করতেই নির্মাতা অয়ন চক্রবর্তী বললেন, ‘খুব চাপের ভেতরে
আছি। টানা শুটিং চলছে। প্রথম ছবি তো, বুঝতেই পারছেন। আপনারা সোহানা সাবাকেই
জিজ্ঞেস করুন না। ওকে নিয়ে আরও বেশি বেশি করে লিখুন। অনেক মেধাবী
অভিনেত্রী।
তা তো লিখবোই,
কিন্তু আপনার কাছে জানতে চাই এই যে চলচ্চিত্রে বাংলাদেশের অভিনেত্রী নেবার
চলতি প্রয়োজন কি দুই বাংলার সহাবস্থানের যে প্রক্রিয়া চলছে তারই
ধারাবাহিকতা-
দেখুন আমি
আমার ‘ষড়রিপু’তে সোহানা সাবাকে অত হিসেব করে কাস্ট করিনি। ফেসবুকে পরিচয়।
এরপর ওর অভিনয় দেখে আমি মুগ্ধ। ষড়রিপু’র কাস্টিং-এর ক্ষেত্রে গল্পের
প্রয়োজনেই আমার মাথায় এলো সাবা’র কথা।
চিরঞ্জিতকে দীর্ঘদিন পর চলচ্চিত্রে কামব্যাক করালো সৃজিত। আপনার ষড়রিপুতে তার চরিত্র প্রসঙ্গে বলুন-
এটা গল্পের প্রয়োজনেই ওর সাথে যোগাযোগ করি। সেই ভেবেই নেয়া। ছবি দেখলেই বুঝবেন দর্শক। এ চরিত্র ওর জন্যই যেন তৈরি হয়েছে।
আমাদের চ্যানেলগুলো তো আপনাদের ওখানে চলে না। এই দূরত্বের ভেতরে কিভাবে দেখলেন সোহানা সাবার অভিনয়?
ইউটিউবে
দেখেছি। তবে যাই বলুন, বাংলাদেশের নাটক আমাদের থেকে হাজার গুণে উন্নত।
অসাধারণ গল্প। অসাধারণ স্টোরিটেলিং। সেখানেই সাবার অভিনয় দেখেছি।
আপনাদের ওখানে তো এখন কমার্শিয়াল ঘরানার ছবি আর ক্লাসিক ঘরানার দুই ভাগে বিভক্ত। সেখানে মোটা দাগে টলিউডের এখনকার অবস্থান কি?
দেখুন,
এখন বলা যায় অবস্থাটা বালিঘড়ির মতো পাল্টে গেছে। একটা সময় কমার্শিয়াল ছবি
ব্লকবাস্টার হিট হতো। কিন্তু এখন না। কারণ গেল বছর সবচেয়ে ব্যবসাসফল ছবির
তালিকায় এখানে কোনো কমার্শিয়াল ছবি নেই।
শোনা
যায় ভেঙ্কটেশ ফিল্মস, সুরিন্দর ফিল্মস বা এসকে মুভিজের ছবিগুলোর পিআর
ভ্যালু নাকি বেশি থাকে। সেক্ষেত্রে আপনি ছবি তৈরি করছেন সেই সব বাঘা বাঘা
ব্যানারের বাইরে। কোনো ঝুঁকি মনে করছেন না?
হা
হা হা। দেখুন ঝুঁকি তো সব কাজেই থাকে। আর এর উত্তর দিতে হলে আপনার ঐ আগের
প্রশ্নেই ফিরে যেতে হবে। কারণ বড় বড় ব্যানারের ছবির পিআর ভ্যালু কি থাকে
না থাকে ওগুলো জাস্ট আওয়াজ। বাঙালি এখন ভালো গল্প চায়। এবং একারণেই এখানে
এখন তথাকথিত কমার্শিয়াল ছবি আর চলছে না। আপনাদের ওখানে কি অবস্থা?
এখানে
কমার্শিয়াল ছবির বাজার এখনও বহাল। তবে যৌথ প্রযোজনার ছবি নিয়েই বর্তমানে
আমাদের মিডিয়া দ্বিধাবিভক্ত। ওখানকার প্রেক্ষাপটে আপনাকে যদি বলা হয় যৌথ
প্রযোজনার ছবি কতটা ফলপ্রসু?
আমার
এই ছবিতে এখনও যৌথভাবে কিছু ভাবিনি। পরেরটা নিয়ে নিশ্চয়ই ভাববো। তবে
অবশ্যই এটা ভালো দিক। কারণ উভয় পক্ষই এখানে লাভবান হবার সুযোগ আছে। যেহেতু
বাংলা নিয়েই এই দুইটা ইন্ডাষ্ট্রি কাজ করছে। সুতরাং এক হলে ক্ষতি নেই। বরং
লাভ আছে। আর এখানে তো এখন অনেকেই কাজ করছেন।
যেহেতু
ওখানে আমাদের নায়িকাদের প্রসঙ্গ এলো, জানতে চাই এই চিত্রটা কতটা ইতিবাচক
মনে করছেন আপনি বা নির্মাতা হিসেবে আপনারাও কি একটা সম্পর্ক উন্নয়নের বিষয়
মাথায় রেখেই আমাদের নায়িকাদের কাস্ট করছেন? কারণ আপনাদের ওখানে তো নায়িকা
সঙ্কট আছে বলে শুনিনি।
হা
হা হা । গভীর প্রশ্ন! দারুণ বলেছেন। দেখুন যাই ঘটুক, এটা অবশ্যই ইতিবাচক
দিক। আমি তো মনে করি আপনাদের সোহানা সাবা এখানকার অনেকের চেয়ে মেধাবী
অভিনেত্রী। এখানে এই চরিত্রে কাজ করার মতো মেয়ে নেই তা আমি বলছি না, আমি
আমার কথা বলতে পারি। সাবা আমার চরিত্রের জন্য পারফেক্ট। এটাই আমার ওকে
কাস্ট করার জন্য প্রধান কারণ ছিল। একজন অভিনেত্রী হিসেবেই ওকে কাস্ট করেছি।
ও বাংলাদেশের অভিনেত্রী হিসেবে আমি প্রভাবিত হইনি। আর এখন এখানে জয়া কাজ
করছে, মহুয়ার একটি ছবিতে রুহী কাজ করেছে, আরো অনেকেই কাজ করছে। তারা যার
যার পয়েন্ট অব ভিউ থেকে কাস্ট হয়েছে। আর কোনো পরিকল্পনা নিয়ে কাস্ট হলেও তো
কোনো ক্ষতি নেই। কারণ আমাদের বাজারটা এখন বড় হওয়া দরকার বাংলা ছবির
উন্নয়নের জন্য। এটাই সবচেয়ে বড় ফ্যাক্ট।
কিন্তু
আপনাদের ওখানে তো আমাদের চ্যানেল দেখা যায় না, তাই আমাদের সবচেয়ে জনপ্রিয়
তারকারও পশ্চিমবাংলায় ভ্যালু ক্রিয়েট হয় না। অন্যদিকে কলকাতার নবাগত
তারকাকে নিয়েও আমাদের এখানে একটা চাহিদা তৈরি হয়ে যায় অনায়াসেই। এই
বৈষম্যের সঙ্কট নিয়ে কি বলবেন। বাজেট তো রয়েছেই।
এটা
অবশ্যই সঙ্কট। তবে সমাধানও হয়ে যাবে আশা করছি। সে কারণেই মনে করুণ এটা
একটা শুরুর পথ তৈরি হলো। আর বাজেট কোনো বাঁধা না। আমি মনে করি চলচ্চিত্র
বাজেট হিসেবে হয় না। চলচ্চিত্র তৈরিতে পরিপূর্ণ খরচ করে তার সঠিক
মার্কেটিংটা জরুরি। বাজেটের ভয়ে ভালো চলচ্চিত্র আটকে থাকে না।
এবারে
একটু অন্য প্রসঙ্গে জানতে চাইবো। আপনি বললেন এখন ক্লাসিক ঘরানার জয়-জয়কার।
কিন্তু একটা গোত্র বিভক্তি এখানে হয়ে আছে। যেমন আমাদের এখানে কেউ কেউ
তামিল ছবির নকল করে। অন্যদিকে আপনাদের কমার্শিয়াল ছবি এখন কপিরাইট নিয়ে
তামিলের বাংলা ভার্সন রিলিজ করা হয়। এখানে দেখুন, আপনাদের হাতে কপিরাইট
থাকছে বলে সেটা আমাদের মতো ‘নকল’ নামে দুষ্ট হচ্ছে না। বা মেকিং-এও দারুণ
দেখাচ্ছেন। তবে কি দুই বাংলার বাণিজ্যিক ঘরানায় গল্পের আকাল পড়লো?
এটা
আমারও প্রশ্ন। কিন্তু দেখুন কপিরাইট নিয়েও এত এত বাংলা ছবি করছে যারা
এখানে। ব্যবসা তো করছে না। একারণেই দর্শকরা মৌলিক গল্পে ফিরতে চায়। ভিন্ন
ঘরানার ছবি হয়েও ‘ভূতের ভবিষ্যত্’ কলকাতার গেল ৫ বছরের সেরা ব্যবসাসফল ছবি।
যে ছবিটি কলকাতায় ব্লকবাস্টার হবার পর বলিউড তার কপিরাইট কিনতে আসে।
আমাদের দুই বাংলার আত্মবিশ্বাসটা মজবুত হওয়া চাই।
শেষ
প্রসঙ্গে জানতে চাইবো, এই দুই ঘরানার ভেতরে শিল্পীরাও কিন্তু আলাদা আলাদা
দ্বীপে। আপনাদের কমার্শিয়াল ছবিতে দেখা যায় অনুপম, রাঘব বা রুপঙ্করকে এমনকি
কবীর সুমনকেও গান গাওয়ার সুযোগ দেয়া হয় না। তারা সবসময় বলিউডের
কণ্ঠশিল্পীদের নিয়ে বাংলা গান করান। বাঙালি শিল্পীরা কি বাণিজ্যিকভাবে...
ঐ
যে বলিউডের শিল্পী আনলে প্রচারটা ফাটে। বিজ্ঞাপনটা ভালো হয়। এছাড়া কোনো
কারণ নেই। যেমন ধরুন আমার ছবি ষড়রিপু’র সঙ্গীত পরিচালক দেব সেন। যিনি
হার্ডকোর কমার্শিয়াল ছবি আওয়ারা, দিওয়ানার সঙ্গীত পরিচালক। এখন ও কাকে দিয়ে
গাওয়াবে সেটা তার ব্যাপার। এমনটাই হয়। পুরোটাই যোগাযোগের ওপর। তবে বাঙালি
শিল্পীরাই সব থেকে মেধাবী। আমাদের এখানে কবির সুমন, রুপম, নচিকেতা বা
আপনাদের জেমসের মতো এত মেধাবী শিল্পী গোটা উপমহাদেশে দেখানতো!