*পাঁচ উপকূলীয় এলাকায় হচ্ছে বাণিজ্যিক চাষ
*রপ্তানি হচ্ছে ১৮ দেশে, বছরে গড় আয় ৪শ কোটি টাকা
*কৃত্রিম উপায়ে পোনা উত্পাদন শুরু
*রপ্তানি হচ্ছে ১৮ দেশে, বছরে গড় আয় ৪শ কোটি টাকা
*কৃত্রিম উপায়ে পোনা উত্পাদন শুরু
*চিংড়ি ছেড়ে কাঁকড়া চাষে ঝুঁকছেন অনেকেই
*৩ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান
প্রায়
অবহেলিত এক জলজ প্রাণী! নোনা পানিতে বসবাস। কিন্তু রান্নার পর এর স্বাদে
এক শ্রেণির ভোজন রসিকরা মুগ্ধ হন। সম্প্রতি ব্রিটেনে প্রিন্স উইলিয়াম আর
কেটের বিয়ের রাজকীয় ভোজসভায় নিমন্ত্রিতদের পাতে প্রথমেই তুলে দেয়া হয়েছিল
এই প্রাণীটি দিয়ে বানানো ‘কর্নিস ক্রাব স্যালাদ’। এক সময়ের অবহেলিত এই জলজ
প্রাণীটির নাম কাঁকড়া।
অনেক
আগেই কাঁকড়া চাষ শুরু হলেও এখন এটি দেশের অর্থনীতিতে সম্ভাবনার এক নতুন
দুয়ার খুলে দিয়েছে। ধর্মীয় কারণে দেশে তেমন একটা চাহিদা না থাকলেও বিদেশে
কাঁকড়ার চাহিদা এখন আকাশছোঁয়া। কাঁকড়া রপ্তানি করে এখন প্রতিবছর গড়ে আয়
হচ্ছে ৪০০ কোটি টাকার বেশি বৈদেশিক মুদ্রা। রপ্তানি তালিকায় অপ্রচলিত এই
‘পণ্য’ই বদলে দিচ্ছে লাখো মানুষের ভাগ্য। যে হারে চাহিদা বাড়ছে তাতে ‘সাদা
সোনা’ হিসেবে পরিচিত গলদা চিংড়িকে অদূর ভবিষ্যতে হার মানাতে পারে এই জলজ
সম্পদ।
দেশের পাঁচ
উপকূলীয় এলাকায় এখন বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে কাঁকড়ার। এটি চাষে চিংড়ির মতো
অগ্নিমূল্যে পোনা কিনতে হয় না। প্রাকৃতিকভাবেই লোনা পানিতে জন্মায় কাঁকড়া।
নদী থেকে ঘেরে পানি উঠালেই লাখ লাখ পোনা আপনাআপনিই উঠে আসে। যে সব গ্রামের
শতভাগ মানুষেরই জীবিকা ছিল সুন্দরবনকেন্দ্রিক। বছরের বারো মাসই যাদের
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সুন্দরবন থেকে মাছ, মধু ও কাঠ আহরণ করে খুব কষ্টে
জীবনযাপন করতে হতো। গত কয়েক বছরের ব্যবধানে কাঁকড়া চাষে সেই সব গ্রামের
মানুষের জীবনচিত্র বদলে গেছে। এখন আর তাদের সংসারে কোনো অভাব নেই। আধুনিক
পদ্ধতিতে কাঁকড়া চাষ করে এ অঞ্চলের হাজার হাজার পরিবার আর্থিকভাবে সচ্ছল
হচ্ছে। খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা আর কক্সবাজারের অনেক চিংড়ি চাষি
ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব আর আন্তর্জাতিক বাজারে চিংড়ির দরপতনের কারণে এখন
কাঁকড়া চাষে ঝুঁকে পড়েছেন। বাংলাদেশ বর্তমানে প্রতি বছর প্রায় ১৮ হাজার টন
কাঁকড়া রপ্তানি করছে, যা দেশের অর্থনীতিকে দিচ্ছে ঊর্ধ্বমুখী গতি।
কাঁকড়ার
প্রজনন ও শরীরতত্ত্ব নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব মেরিন
সায়েন্সেসের এক বিভাগীয় গবেষণায় বলা হয়েছে, কাঁকড়ার শক্ত খোলসের ভেতর
লুকিয়ে আছে কোটি কোটি টাকা আয়ের সম্ভাবনা। ‘উপকূলীয় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর
অংশগ্রহণের মাধ্যমে কাঁকড়া চাষের সম্ভাব্যতা পরীক্ষণ’ শীর্ষক ডিএফআইডির
আর্থিক সহায়তায় ওই গবেষণাটি সম্প্রতি সমাপ্ত করেন ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড.
মোহাম্মদ জাফর। গবেষণায় উঠে এসেছে, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাঁকড়ার বাজার
চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ১৯৯৩ সাল থেকে সনাতন পদ্ধতিতে বাংলাদেশে পুকুরে কাঁকড়ার
চাষ শুরু হয়। ১৯৯৫ সালে হংকংয়ে কাঁকড়া বাণিজ্যিকভাবে রপ্তানির মাধ্যমে
শুরু হয় অর্থনৈতিক গতিশীলতা। বর্তমানে শুধু মালয়েশিয়ায়ই প্রতিবছর ৮০০ থেকে
এক হাজার টন কাঁকড়া রপ্তানি হয়। এছাড়া ভারত, ইন্দোনেশিয়া, তাইওয়ান, জাপান,
সিঙ্গাপুর, কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, বার্মা, শ্রীলংকা, কোরিয়া এবং ইউরোপের
কয়েকটি দেশসহ মোট ১৮টি দেশের বাজারে বাংলাদেশের কাঁকড়া রপ্তানি হচ্ছে।
ড.
জাফর জানান, উপকূলীয় দরিদ্র জেলে আর কৃষকরা প্রাকৃতিক উত্স থেকেই কাঁকড়া
আহরণ করেন। এরপর স্থানীয় আড়তদারদের কাছে বিক্রি করে তারা কেজিপ্রতি আড়াইশ’
টাকার বেশি পান না। অথচ ঢাকার মিরপুরে বিভিন্ন পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি
কাঁকড়ার দাম আটশ’ থেকে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত ওঠে। কাঁকড়ার পুষ্টিমানের
বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড.
শাহ মোহাম্মদ কেরামত আলী বলেন, ‘কাঁকড়া খুবই সুস্বাদু। একটি পরিপূর্ণ
সামুদ্রিক মাছের সমপরিমাণ ভিটামিন ও প্রোটিন পাওয়া যায় এতে।’
তবে
ঢালাওভাবে কাঁকড়া রপ্তানির ফলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিঘ্নিত হবে বলে অভিমত
দিয়েছেন ‘ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার’র (আইইউসিএন)
রিপ্রেজেন্টেটিভ ড. নিয়াজ আহমদ খান। তিনি বলেন, ‘কাঁকড়ার বেশ কিছু প্রজাতি
আইইউসিএন প্রণীত রেডলিস্ট (বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীর তালিকা) অন্তর্ভুক্ত। এ
কারণে কাঁকড়ার চাষ সম্পর্কে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে সচেতনতার মাত্রা আরো
বাড়াতে হবে।’ তিনি জানান, বর্তমানে ১২ প্রজাতি কাঁকড়ার মধ্যে ২ প্রজাতির
কাঁকড়া মাত্রাতিরিক্ত আহরণের কারণে বিলুপ্তির মুখে পড়েছে। সামুদ্রিক
সাঁতারু কাঁকড়া ও তিন দাগবিশিষ্ট সাঁতারু কাঁকড়া বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীর
তালিকায় উঠে আসায় সমপ্রতি সরকার এই দুই প্রজাতির কাঁকড়া আহরণ ও রপ্তানি
নিষিদ্ধ করেছে। এছাড়া জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি দুই মাস কাঁকড়ার প্রজনন
সময়। স্ত্রী কাঁকড়ার প্রজননের সময় এবং অপ্রাপ্ত বয়স্ক থাকাকালে শিকার
নিষিদ্ধ করে সরকার একটি আইন করেছে। তবে রপ্তানি করা কাঁকড়ার সবক’টি
প্রজাতিই প্রকৃতি অর্থাত্ সমুদ্রের মোহনা, নদী বা ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল থেকে
আহরিত হয় না। কয়েকটি সংগ্রহ করা হয় উপকূলীয় চিংড়ি খামার থেকে।
মত্স্য
অফিস সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরবন এলাকায় সহস্রাধিক প্রজাতির কাঁকড়া রয়েছে।
এদের মধ্যে বাংলাদেশ সীমানায় ১২ প্রজাতির কাঁকড়া পাওয়া যায়। এসব কাঁকড়ার
মধ্যে মাইলা, শাইলা, সিরোটা ও শীলা প্রজাতি উল্লেখযোগ্য। মাইলা ও শীলা
জাতের কাঁকড়া সবচেয়ে উন্নতমানের, তাই বিদেশে এগুলোর চাহিদা বেশি। বৈশাখ
থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত কাঁকড়ার মৌসুম। বাংলাদেশ থেকে কাঁকড়া রপ্তানি হচ্ছে
প্রায় ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে। কিন্তু সরকারিভাবে এটি এখনও রপ্তানি পণ্য
হিসেবে গণ্য হয়নি। কাঁকড়া আহরণ পরিবেশের ক্ষতি করে এ যুক্তিতে সরকার ১৯৯৭
সালের নভেম্বরে দেশজুড়ে কাঁকড়া আহরণ ও রপ্তানি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এতে
বিদেশে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের কাঁকড়ার বাজার দখল করে নেয় ভারত, মিয়ানমারসহ
কয়েকটি দেশের ব্যবসায়ীরা। কিছুদিন পরে কাঁকড়া ব্যবসায়ীদের চাপের মুখে সরকার
রপ্তানির অনুমতি দিলেও আহরণের ক্ষেত্রে সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়।
সূত্র
আরো জানায়, ১৫ বছর ধরে রপ্তানি হতো মূলত প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা কাঁকড়া।
চাষিরা নদী, সাগর, ডোবা, জলাশয় থেকে কাঁকড়া আহরণ করে প্রক্রিয়াজাত করার
মাধ্যমে সেগুলো রাজধানীতে পাঠাতেন। রপ্তানিকারকরা সেগুলো নিজেদের মতো করে
প্রক্রিয়াজাত করে রপ্তানি করতেন। কিন্তু সামপ্রতিক বছরগুলো শুধু চাষ করা
কাঁকড়াও রপ্তানি হচ্ছে। মাত্র একশ’ শতাংশ জমিতে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা খাটিয়ে
বছরে গড়ে ৩০০ কেজি কাঁকড়া উত্পাদন করা সম্ভব, যার বাজার মূল্য প্রায় দুই
লাখ টাকা। শুধু খুলনা অঞ্চল থেকেই প্রত্যেক বছর প্রায় ৮০ কোটি টাকা মূল্যের
কাঁকড়া রপ্তানি হচ্ছে। কয়েক বছর আগেও খুলনায় বিভিন্ন গ্রেডের কাঁকড়ার দাম
কেজিপ্রতি ২০০ টাকা থেকে ২৫০ টাকা ছিল। এখন তা বেড়ে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকায়
বিক্রি হচ্ছে। কাঁকড়ার চাষ ও রপ্তানি এখন অত্যন্ত লাভজনক।
চিংড়ি ছেড়ে কাঁকড়া চাষে :
দেশের অনেক চিংড়ি চাষি এখন কাঁকড়া চাষে ঝুঁকছেন। খুলনার পাইকগাছার চিংড়ি
চাষি বরুন কুমার জানান, চিংড়ি ঘের করে পর পর কয়েক বছর ভাইরাসের আক্রমণে
সর্বস্বান্ত হওয়ার পর ২০১১ সাল থেকে চিংড়ি চাষ বাদ দিয়ে ঘেরে কাঁকড়া চাষ
করছেন। কাঁকড়া চাষে চিংড়ির মতো পোনা কিনতে হয় না। প্রাকৃতিকভাবেই নোনা
পানিতে কাঁকড়া জন্মায়। নদী থেকে ঘেরে পানি উঠালেই লাখ লাখ পোনা পাওয়া যায়।
এর পর নার্সিংয়ের মাধ্যমে এগুলো বড় করে তোলা হয়। ১৮০ গ্রামের ঊর্ধ্ব
গ্রেডের কাঁকড়ার স্থানীয় বাজার দর ৮০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা কেজি। চলতি
মৌসুমে ১৬ বিঘা জমিতে তিনি কাঁকড়া চাষ করেছেন। উত্পাদন খরচ বাদে এবার ৬-৭
লাখ টাকা লাভ হবে বলে আশা করছেন তিনি।
বাংলাদেশের
‘হোয়াইট গোল্ড এলাকা’ (চিংড়ি উত্পাদন এলাকা) বলে পরিচিত সাতক্ষীরার
সুন্দরবন উপকূলীয় অঞ্চলে কাঁকড়া চাষ কৃষকদের মাঝে ব্যাপক জাগরণ সৃষ্টি
করেছে। এ অঞ্চলের কৃষকের মুখে ফিরেছে হাসি। কাঁকড়া চাষে জায়গা কম লাগে,
খরচও অল্প। বালাইয়ের আক্রমণ নেই বললেই চলে। কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা যায়,
চিংড়ির চেয়ে কাঁকড়া চাষ অনেক সহজ। লাভও ভালো। এতে নি:স্ব হওয়ার আশংকা নেই।
শ্যামনগর
উপজেলার সুন্দরবনসংলগ্ন মুন্সীগঞ্জ ইউনিয়নের কাঁকড়া চাষি স্বপন কুমার মালো
জানান, আইলায় সর্বস্ব হারানোর পর কয়েক বছর তার সংসার চলত অনেক কষ্টে।
কিন্তু পাঁচ-ছয় বছর ধরে কাঁকড়া চাষ করে আর্থিকভাবে স্বনির্ভর হয়েছেন।
সংসারের খরচ চালিয়েও বছরে ৪-৫ লাখ টাকা তার আয় হয় কাঁকড়া উত্পাদন করে।
বর্তমানে চাষের পাশাপাশি একটি আড়তও করেছেন তিনি।
এই
এলাকার যে নারীদের একদিন অভাব অনটনে নুন আনতে পান্তা ফুরাচ্ছিল, তাদের
জীবনে কাঁকড়া এনেছে সুখের দোলা। অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এখন রপ্তানিকৃত
মত্স্য সম্পদের মধ্যে চিংড়ির পরই কাঁকড়ার অবস্থান। সারাদেশে আড়াই থেকে তিন
লাখ লোক কাঁকড়া সংগ্রহ, চাষ, মোটাতাজাকরণ ও বিপণন করে জীবিকা নির্বাহ
করছেন। কেবল সুন্দরবন এলাকায় ৫০ থেকে ৬০ হাজার নারী-পুরুষ এ পেশায় সরাসরি
জড়িত।
শ্যামনগর উপজেলা
মত্স্য অধিদফতরের তথ্য মতে, উপজেলার ৫০০ প্রজেক্টের মাধ্যমে ১৫ হেক্টর
জমিতে কাঁকড়া চাষ হচ্ছে। শ্যামনগরে নওয়াবেঁকী গণমুখী ফাউন্ডেশন জানায়,
উপকূলীয় অঞ্চলের কাঁকড়া চাষিদের উন্নয়নে ঋণ সহায়তার পাশাপাশি ওরিয়েন্টেশনের
মাধ্যমে তাদের সম্যসা সমাধানের ধারণা দেয়া হচ্ছে। এতে চাষিরা ব্যাপক
সাফল্য পাচ্ছেন। অল্প জায়গায় অধিক উত্পাদন ও ভাইরাসের আক্রমণ কম হওয়ায়
কাঁকড়া চাষে চাষিরা ঝুঁকছেন বেশি। কাঁকড়া চাষ করে সাতক্ষীরার উপকূলীয়
এলাকার মানুষের দিন বদলে যাচ্ছে। সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকার অধিকাংশ গ্রামে চাষ
করা হচ্ছে কাঁকড়া। পোনা কিনতে হয় না, ঝুঁকি কম ও পরিবেশবান্ধব হওয়ায় আইলা
দুর্গত অঞ্চলের মানুষজন কাঁকড়া চাষ করে স্বনির্ভর হচ্ছে। তাছাড়া স্থানীয়
এনজিও আধুনিক পদ্ধতিতে কাঁকড়া চাষের ওপর প্রশিক্ষণ দিচ্ছে চাষিদের। বিশ্বের
বিভিন্ন দেশে সাতক্ষীরায় উত্পাদিত কাঁকড়া রপ্তানি করে সরকার বছরে বিপুল
পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে। জেলার ২০ হাজারের অধিক চাষি কাঁকড়া চাষ
করছেন। এ শিল্পের সঙ্গে পাঁচটি উপজেলার প্রায় দুই লাখ মানুষ সরাসরি যুক্ত।
মত্স্য
কর্মকর্তারা জানান, বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলের দেড় লাখেরও বেশি জেলে প্রাকৃতিক
উত্স থেকে কাঁকড়া ধরে জীবনযাপন করছেন। খুলনার পাইকগাছা, দাকোপ, সাতক্ষীরার
শ্যামনগর, তালা, বাগেরহাটের রামপাল ও মংলা এলাকায় ছোট ছোট পুকুরে কাঁকড়া
মোটাতাজা করা হচ্ছে। এসব এলাকায় নয় শতাধিক কাঁকড়া মোটাতাজাকরণ খামার গড়ে
উঠেছে। শুধু পাইকগাছা উপজেলায় রয়েছে ৩০০ খামার। সাতক্ষীরায় বাংলাদেশ মত্স্য
গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) নোনা পানির গবেষণা কেন্দ্রেও গড়ে উঠেছে
একটি কাঁকড়া মোটাতাজা করার গবেষণা ক্ষেত্র।
কৃত্রিম পোনা উত্পাদন: কাঁকড়া
চাষ বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং চাহিদা ও কদর বাড়ার কারণে দেশে বাগদা চিংড়ির মতোই
এবার কৃত্রিম প্রজননে কাঁকড়ার পোনা উত্পাদন শুরু হয়েছে। কক্সবাজার
সামুদ্রিক মত্স্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্রের এক দল গবেষক সৈকতের লাবণী পয়েন্টের
সামুদ্রিক মত্স্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্রে বিশেষ পদ্ধতিতে উত্পাদিত কাঁকড়ার
পোনা সংরক্ষণ করছেন। এখানে ২০০৩ সালে প্রথম কাঁকড়ার পোনা উত্পাদন ও চাষ
বিষয়ে গবেষণা শুরু হয়। ২০১৪ সালের নভেম্বরে কাঁকড়ার পোনা উত্পাদনের নতুন
গবেষণা কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়। গভীর সমুদ্র থেকে ধরে আনা মা কাঁকড়া
হ্যাচারিতে বিশেষভাবে সংরক্ষণ করে ডিম থেকে বের করে আনা হয় ‘জুইয়া’ (কাঁকড়া
ডিম ছাড়ার পর পোনার প্রাথমিক অবস্থা)। এরপর সেই ‘জুইয়া’ প্রযুক্তি
কেন্দ্রের বিশেষ ল্যাবে সংরক্ষণ করে বাঁচিয়ে রাখা হয়। দীর্ঘ গবেষণার পর গত ২
ফেব্রুয়ারি কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা উত্পাদনে সক্ষম হন গবেষক দল।
গবেষক
দলের প্রধান মো. ইনামুল হক বলেন, কাঁকড়া উত্পাদনে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে
পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না পর্যাপ্ত পোনার অভাবে। কারণ পোনার জন্য ভরসা
প্রাকৃতিক উত্স। ফলে পোনা আহরণে পোহাতে হয় নানা ঝক্কি। চাষিদের সেই সমস্যা
বিবেচনা করেই আমরা কৃত্রিম প্রজননে পোনা উত্পাদনের গবেষণায় নামি। তিনি
বলেন, হ্যাচারিতে কাঁকড়ার পোনা উত্পাদন অপেক্ষাকৃত নতুন প্রযুক্তি। এ
ক্ষেত্রে মূল বাধা হলো পোনার বাঁচার হার কম। একটি পরিপক্ব কাঁকড়ার ডিম
দেয়ার ক্ষমতা ৮০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৪০ লাখ। কিন্তু পোনা বাঁচার হার গড়ে
১০ শতাংশ। গবেষক দল হ্যাচারিতে তিনটি পরিপক্ব মা কাঁকড়া সংরক্ষণ করে প্রায়
৩২, ১৬ ও ২৬ লাখ ‘জুইয়া’ পান। তা পূর্ণাঙ্গ পোনায় পরিণত হতে আরো ছয়টি ধাপ
অতিক্রম করতে হয়। এ ক্ষেত্রে আমরা সফল হয়েছি। এখন বাণিজ্যিকভাবে কাঁকড়ার
পোনা উত্পাদনের প্রক্রিয়া চলছে।
একজন
হ্যাচারি মালিক জানান, মত্স্যবিজ্ঞানীরা এখন কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে ডিম
থেকে কাঁকড়ার পোনা উত্পাদন করছেন। এরপর এই প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে
হ্যাচারিতে পোনা উত্পাদন ও বিপণন শুরু হলে দেশে কাঁকড়া চাষের নতুন সম্ভাবনা
দেখা দেবে। তখন সনাতন পদ্ধতি বাদ দিয়ে চাষিরা এই পদ্ধতি অনুসরণ করবেন।
প্রয়োজন পৃষ্ঠপোষকতা:
কাঁকড়া চাষিরা মনে করেন, কাঁকড়া উত্পাদন ও রপ্তানি বাড়াতে প্রয়োজনীয়
ব্যবস্থা নিলে নতুন দিগন্ত খুলে যাবে। এজন্য উত্পাদন বৃদ্ধিতে প্রয়োজনীয়
গবেষণা পরিচালনা করা জরুরি। দরকার সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রক্রিয়াজাতকরণের
সমস্যার সমাধান। কারণ কাঁকড়ার চাষ লাভজনক দেখে অনেক বেকার যুবক এ চাষে
উত্সাহী হওয়া সত্ত্বেও অর্থনৈতিক সংকট ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ছিটকে পড়ছেন।
পৃষ্ঠপোষকতা পেলে উপকূলীয় অঞ্চলের বেকার যুবকদের কাঁকড়া চাষের মাধ্যমে
আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ প্রদান করা সম্ভব হবে।