Media news - শমীর প্রেরণা শেখ হাসিনা

শমী কায়সার অভিনেত্রী, প্রযোজক ও নারী উদ্যোক্তা শমী কায়সার। প্রখ্যাত লেখক এবং ঔপন্যাসিক শহীদুল্লা কায়সারের মেয়ে তিনি। শমীর মা পান্না কায়সার রাজনীতির পাশাপাশি লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত। ১৯৮৯ সালে পরিচালক আতিকুল হক চৌধুরীর ‘কেবা আপন কেবা পর’ নাটকে অভিনয়ের সুযোগ পান শমী। পরবর্তী সময়ে ‘যত দূরে যাই’, ‘নক্ষত্রের রাত’, ‘ছোট ছোট ঢেউ’, ‘অরণ্য’, ‘আকাশে অনেক রাত’, ‘মুক্তি’, ‘অন্তরে নিরন্তরে’, ‘স্বপ্ন’, ‘ঠিকানা’সহ বহু নাটকে অভিনয় করে বিভিন্ন মহলে প্রশংসিত হন। শমী ঢাকা থিয়েটারের সদস্য। মঞ্চ, টিভি নাটকে অভিনয়ের পাশাপাশি কয়েকটি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন। এক সময় নিয়মিত অভিনয় করলেও এখন অভিনয় থেকে দূরে আছেন তিনি। নারী দিবস নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মনজুর কাদের।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নারী দিবসে আপনার প্রত্যাশা কী?
নারীর মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি। কারণ, নারীর ক্ষমতায়ন বলতে আমরা অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন বুঝি, সামাজিক ক্ষমতায়ন বুঝি। রয়েছে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাও। সত্যিকার অর্থে, নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা আমরা যতটা ঠিক চাচ্ছি, পাচ্ছি না। অর্থনৈতিক মুক্তিও কিন্তু আশানুরূপ হয়নি। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নারীরা এগিয়েছে অনেক; কিন্তু বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরা যে বিষয়টি এড়িয়ে যাই সেটা হচ্ছে নারীর মানসিক স্বাস্থ্য। অর্থাৎ সমাজে তিনি বিভিন্নভাবে নিগৃহীত হন, পরিবারে নিগৃহীত হন, কাজের ক্ষেত্রে নিগৃহীত হন, অর্থনৈতিকভাবে নিগৃহীত হন। পরিবারে ভাই-বোনের সম্পত্তির ব্যাপারেও নারীরা বৈষম্যের মুখোমুখি। আর সে কারণে নারীদের মনের ওপর যে মানসিক চাপ সৃষ্টি হয়, এ বিষয়টি নিয়ে এখন ভাবার সময় এসেছে।

চাওয়ার সঙ্গে বাস্তবতার মিল কতটুকু বলে আপনি মনে করেন?অনেক বেশি মিল। নারীরা অনেক বেশি চাপা স্বভাবের। তাঁরা তাঁদের নিজেদের কথা অনেক বেশি চেপে রাখেন। পরিবারের সুখ, চারপাশের শান্তির, সমাজের কথা এবং চক্ষুলজ্জার জন্য নারীরা অনেক কিছুই চেপে যান। এসব ব্যাপার একজন নারীকে মানসিকভাবে অনেক চাপে ফেলে দেয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ বিষয়টা নিয়ে ভাবা অনেক বেশি জরুরি এবং এটা খুব ভালোভাবে সম্ভব।

জীবনসংগ্রামে নারী হিসেবে আপনাকে আলাদাভাবে কোনো বাধার মুখোমুখি হতে হয়েছে কি না?পদে পদেই তো বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে; এখনো হচ্ছে। আমি যখন অভিনয় শিখি, তখনই প্রথম বাধা ছিল পরিবার থেকে। আমার মা তখন আমাকে অনেক বেশি সাপোর্ট দিয়েছেন। তবে পরিবারের অন্য সবার মধ্যে বড় একটা অংশের দ্বিমতও ছিল। আমি মূল বাধার মুখে পড়েছিলাম, যখন অভিনয় থেকে অ্যাডভারটাইজিং ব্যবসায় এলাম, ডেভেলপমেন্ট সেক্টরে কাজ শুরু করলাম। সেই বাধাগুলো আমি মোকাবিলা করেছি। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একজন নারীর ব্যবসা করাটা সত্যিই বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। আর সেই নারী যখন অবিবাহিত হন, ডিভোর্সি হন—তখন বাধাটা হয় আরও প্রকট।

মডেল, অভিনেত্রী, নির্মাতার পাশাপাশি উদ্যোক্তা হিসেবেও আপনি পরিচত। আপনি নিজেকে কোন ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সফল মনে করেন?

আমি এখনো মনে করি, আমি অভিনয়ের মানুষ। মনেপ্রাণে বিশ্বাসও করি।

বর্তমান সময়ে আমাদের সমাজ-সংস্কৃতি নারীর স্বাধীন বিকাশের জন্য অনুকূল বলে মনে করেন কি না? না হলে কোন বিষয়গুলোকে বাধা বলে মনে করেন?

নারীর উন্নয়ন সাদা-কালোভাবে দুটি ভাগে দেখি। কিছু মেয়ে আসছেন শুধু জীবিকার কারণে। খুব তাড়াতাড়ি খ্যাতির শীর্ষে যাওয়া আর বেশি আয় করাই হচ্ছে তাঁদের মানসিকতা। সেখানেই ঘটছে মূল সমস্যা। নারীর মনস্তাত্ত্বিক যে উন্নয়নটা দরকার, তা সেভাবে হচ্ছে না। যে নারী মিডিয়াতে কাজ করবেন, তাঁর দেশ, সমাজ, সংস্কৃতি, সভ্যতা, দেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে যে জ্ঞান থাকা দরকার, ইদানীং তা খুব একটা দেখছি না। আরেকটা পক্ষ আসছেন শুধু ভালোবেসে। আর তাঁরাই সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, মুক্তিযুদ্ধ, দেশ, সৃজনশীলতা সবকিছুকে আত্মস্থ করে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। আমার কাছে মনে হয়, কখনো কখনো হয়তো পিছিয়ে পড়ছেন। আপাতদৃষ্টিতে এমনটা মনে হলেও এই সংখ্যার নারীরা কিন্তু এগিয়ে যাবেন। যেসব মেয়ে অর্থনৈতিক কারণে কিংবা অন্য কোনো চাপে খ্যাতির জন্য মিডিয়াতে কাজ করছেন, তাঁদের প্রতি আমার বলা হচ্ছে, সত্যিকার অর্থে তাঁরা যে ক্ষেত্রে কাজ করার জন্য আসছেন, সেখানেও কিছু দিতে পারবেন না, পরিবারকেও কিছু দিতে পারবেন না। অর্জনের জায়গায় আসলে পিছিয়ে পড়ছেন তাঁরা।

আমাদের দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গন ও গণমাধ্যমে নারীর উপস্থিতিকে কীভাবে দেখেন? যে উপস্থিতি দেখা যায় তাতে নারীদের জীবনসংগ্রামের প্রতিফলন কতটুকু বলে মনে করেন আপনি?

উপস্থিতির ব্যাপারটি আমি ইতিবাচকভাবেই দেখি। জীবনসংগ্রামের প্রতিফলন যতটুকু হওয়ার দরকার, আমার মনে হয় ততটুকু হয় না। নারীদের কাজের ক্ষেত্রে যে পরিমাণ সম্মান দেখানোর প্রয়োজন রয়েছে তা এখনো আমরা অর্জন করতে পারিনি।

অনুপ্রাণিত হয়েছেন এমন নারীদের কথা জানতে চাই।

আমি প্রথমত অনুপ্রাণিত হয়েছি আমার মা পান্না কায়সারের কাছ থেকে। সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে তিনি আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছেন। আরও কিছু নারীর প্রচ্ছন্ন ছাপ আমার মধ্যে রয়েছে। ছোটবেলায় সুফিয়া কামালের কাছে গল্প শুনতে যেতাম, বড় হওয়ার পর ভাবি যে তাঁরও একটা প্রভাব আমার মধ্যে আছে। অভিনয়ের ক্ষেত্রে শিমূল ইউসুফ, সুবর্ণা মুস্তাফা দ্বারা আমি খুব বেশি অনুপ্রাণিত। ব্যবসার ক্ষেত্রে আমার অনুপ্রেরণায় আছেন গীতি আরা সাফিয়া চৌধুরী, রোকেয়া আফজাল। এ মুহূর্তে যিনি আমার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা তিনি জননেত্রী শেখ হাসিনা। তিনি আমাকে ভীষণভাবে ভাবনায় ফেলেন এবং নানান ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা জুগিয়ে যাচ্ছেন। জীবনের এত চড়াই-উৎরাইয়ের পরও তিনি এখনো দাঁড়িয়ে আছেন এবং সফলতার সঙ্গে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। এত কিছুর পরও পরিবার এবং দেশকে নিয়ে তিনি যেভাবে এগোচ্ছেন, তা থেকে অনেক কিছুই শেখার আছে।

কর্মজীবী নারীকে ঘর-বাইর দুটোই সামলাতে হয়। নারী হিসেবে কর্মক্ষেত্র এবং ব্যক্তিজীবনের মধ্যে সমন্বয়ের ক্ষেত্রে আপনার কোনো পরামর্শ আছে কী?

সমন্বয়ের ক্ষেত্রে আমার পরামর্শ হচ্ছে সবার আগে পরিবার। পরিবারকে সামলে নিয়ে সবকিছু করতে পারাটার মধ্যে আছে সব কৃতিত্ব। আমি নিজেও সবার আগে পরিবারকে প্রাধান্য দিই। পরিবারকে ঠিকভাবে সামলে নিতে পারলে সেই নারী সহজে কর্মক্ষেত্রও সামলে নিতে পারবেন।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নতুন প্রজন্মের নারীদের কীভাবে দেখতে চান? তাঁদের জন্য বিশেষ কোনো পরামর্শ?

নতুন প্রজন্মের মেয়েরা প্রথমে নিজেকে ভালোভাবে জানবেন। তারপর সমাজ এবং দেশকে জানবেন-চিনবেন। নিজের ওপর এবং নিজের কাজের ওপর আস্থা রাখবেন। সমাজে নানা ধরনের অস্থিরতা আছে, অনেক কিছুর প্রলোভনও আছে—সেখান থেকে নিজের বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে সুচিন্তিতভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার মানসিকতা থাকতে হবে। অল্প বয়সে আমিও ভুল করেছি। আমরা চাই, আমাদের পরের প্রজন্ম যাতে এই ভুলগুলো না করে। পাশাপাশি যে সমাজে আমি কাজ করছি, সেই সমাজকে আমি কী দেব, সমাজ আমাকে কী দিচ্ছে, কীভাবে দিচ্ছে—এগুলো নিয়ে ভাবা। মেয়েদের বলতে চাই, কারও কাছে নিজেকে প্রমাণ করার জন্য কোনো কাজ করবেন না। ভালোবেসে কাজ করবেন সবাই।
-

Latest

Popular Posts

Popular Posts

Popular Posts