একটা সময় ছিল যখন গ্রামের বাড়িতে অতিথি এলে বসতে দেয়া হতো পাটিতে।
গৃহকর্তার বসার জন্যও ছিল বিশেষ ধরনের পাটি। হিন্দুদের বিয়ের অন্যতম
অনুষঙ্গ শীতলপাটি। গরমকালে শীতলপাটির কদর একটু বেশিই। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠের
দুপুরে এই পাটি দেহ-মনে শীতলতা আনে।
দেশের যে কয়টি জেলায় শীতলপাটি
তৈরি হয় তার মধ্যে কাউখালী অন্যতম। পিরোজপুরের কাউখালী উপজেলা সদর থেকে এক
কিলোমিটার দক্ষিণে সুবিদপুর গ্রামে। যে গ্রামের ৫০টি পরিবার আজো পাটি
শিল্পকে তাদের বাঁচার একমাত্র অবলম্বন হিসেবে আঁকড়ে রয়েছে। এখানকার তৈরি
শীতলপাটি পাইকারদের হাত ঘুরে চলে যায় ঢাকা, বরিশাল ও খুলনা বাজারে।
রপ্তানিপণ্য হিসেবে স্বীকৃতি না পেলেও শৌখিন ব্যবসায়ী, বেড়াতে আসা অতিথিদের
মাধ্যমে শীতলপাটি যাচ্ছে কলকাতা, মধ্যপ্রাচ্য, ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্রসহ
অনেক দেশে। অনেকে আবার নকশা করা শীতলপাটি দেয়ালে টাঙিয়ে রাখেন ঘরের শোভা
বাড়াতে। এক সময় ওই গ্রামের শতাধিক পরিবার এই পাটি তৈরির সঙ্গে জড়িত ছিল।
কাঁচামালের অভাবে পাটি তৈরির ব্যয় বেশি হওয়ায় বাজারে চাহিদা কমে গেছে। ফলে
অনেকে এ ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে দিনমজুরের কাজ করছে। কালের বিবর্তনে কাউখালীর সেই
পাটিশিল্প আজ বিলীনের পথে। সুখ নেই পাটিকরদের মনে। রাত-দিন সমানে পরিশ্রম
করেও দু’বেলা দু’মুঠো আহার জোগাতে পারছে না তারা। উচ্চ শিক্ষা দূরের কথা
নাম দস্তখত শেখারও সুযোগ পায় না ৯০ ভাগ শিশু। কেবল একটুকরা জমির অভাবে
কাঁচামাল পাইত্রা উত্পাদন করতে পারছে না বলে আজ ওই শিল্প বিলীনের পথে। অনেক
পরিবার সামান্য ভিটেমাটি বিক্রি করে ভারতে চলে গেছে। এলাকার লোকজন জমি
কিনে পাইত্রা বাগান পরিষ্কার করে অন্য ফসল উত্পাদন করছে।
জেলার
শীতলপাটি তৈরির বড় গ্রাম সুবিদপুরে পাটিকররা এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন।
কারণ, গ্রীষ্মে এই পাটির চাহিদা প্রচুর। এই তিন-চার মাসের আয় দিয়ে তাদের
সারা বছরের খোরাকি চলে।
পাটিকরদের একটি সমিতি রয়েছে। সমিতির
সভাপতি খোকন পাটিকর জানান, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর
রহমান ওই সমিতিতে ৮ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। পরবর্তী সময় রাষ্ট্রপতি জিয়াউর
রহমান সমিতির ঘর নির্মাণের জন্য ৫০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। এরপর জাতীয়
পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর স্ত্রী সাবেক এমপি তাসমিমা
হোসেন টিন কেনার জন্য টাকা দিয়েছিলেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আশার আলো
প্রকল্পের অধীন ৩ লাখ টাকা মূলধন হিসেবে দিয়েছে। যা সমিতির সদস্যদের মধ্যে
বিনা সুদে ঋণ দেয়া হচ্ছে। নাম দস্তখত সর্বস্ব ওইসব পাটিকরের নিরক্ষরতার
সুযোগে সুপারভাইজিং অথরিটির লোকজন স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা চালায়। এছাড়া
বিভিন্ন এনজিও থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে কিস্তি পরিশোধ করতে হিমশিম খাচ্ছে
পাটিকররা।
সুবিদপুর শীতলপাটি সমবায় সমিতির সভাপতি খোকন পাটিকর ও
বয়স্ক কয়েকজন পাটিকরের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ক্ষেত থেকে পাইত্রা কেটে
প্রথমে ছাঁটা হয়। তারপর বঁটি দিয়ে লম্বালম্বিভাবে তিন ফালি, ক্ষেত্রবিশেষে
পাঁচটি ফালিও করা হয়। ফালিগুলো একটি বড় মাটির পাত্রে (মটকি) ভাতের মাড় দিয়ে
কমপক্ষে সাত দিন ভিজিয়ে রাখা হয়। পরে আবার ভাতের মাড় ও পানিতে সিদ্ধ করা
হয়। সিদ্ধ ফালি পানি দিয়ে ধুয়ে বেতি (চিকন ফালি) বানিয়ে শুরু হয় পাটি বোনার
কাজ।
বেতির ওপরের অংশ দিয়ে তৈরি হয় মসৃণ শীতলপাটি। আর মধ্যভাগ
দিয়ে তৈরি হয় মোটাপাটি ও বুকাপাটি। মোটাপাটি ও বুকাপাটির দাম শীতলপাটির
চেয়ে অনেক কম।
পাঁচ ফুট প্রস্থ ও সাত ফুট দৈর্ঘ্যের ভালো মানের
একটি শীতলপাটি কাউখালীর বাজারে এক হাজার থেকে এক হাজার ৬০০ টাকায় বিক্রি
হয়। মধ্যম মানের একটি পাটির দাম ৬০০ থেকে এক হাজার টাকা। এ ছাড়া ৪০০-৫০০
টাকায়ও কিছু শীতলপাটি মেলে।
পাটিকর মঞ্জু রানী জানান, একটি
শীতলপাটি তৈরি করতে সাধারণত তিন-চার দিন লাগে। একজন বয়স্ক পাটিকর একাই সাত
দিনে একটি উন্নত মানের পাটি তৈরি করতে পারেন। এত কষ্টে তৈরি পাটির দাম শুনে
ক্রেতারা প্রায়ই অনুযোগ করেন, সামান্য শীতলপাটির এত দাম!
গড়
হিসেবে দেখা যায়, একটি পরিবারের তিন সদস্য মিলে কাজ করলেও মাসে ১০টির বেশি
পাটি তৈরি সম্ভব নয়। ১০টি পাটি বিক্রি করে মাসে সর্বোচ্চ ছয়-সাত হাজার টাকা
আয় হয়। এই আয়েই চলে পাটিকরদের সংসার। সুবিদপুর গ্রামের পাইত্রা বন থেকে
প্রতিবছর যে পাইত্রা উদপাদন হয় তা দিয়ে সারা বছর পাটি তৈরি সম্ভাব হয় না ।
কারণ পাইত্রা বাগান কেটে জমি তৈরি করছে।
শ্যামল চন্দ্র নামের এক
পাটিকর বলেন, পাটিশিল্পের বিকাশে বড় সমস্যা হলো আর্থিক সমস্যা। শীতলপাটি
তৈরির জন্য পাটিকরদের সরকারি, বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কোনো ঋণ দেয়
না। সরকার শীতলপাটি রপ্তানির উদ্যোগ নিলে পাটিকরদের দিন ঘুরে যেত।
পাটিকরদের দাবির প্রতি একমত পোষণ করে কাউখালীর উপজেলা চেয়ারম্যান এস, এম
আহসান কবীর জানান, ঐতিহ্যবাহী কুটিরশিল্প শীতলপাটির বিপণন ব্যবস্থা উন্নত
করা হলে এই পেশার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা সারা বছর ভালোভাবে বেঁচে থাকতে
পারবেন। এদের মূল দাবি কিছু খাস জমি যেখানে পাইত্রার চাষ করা সম্ভব।