নয়
মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে জন্ম হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের। আজ
থেকে ৪৩ বছর আগের ঘটনা। সে সময় যাঁরা যুদ্ধ করেছিলেন তাঁদের অনেকেই নেই।
মানুষের জন্ম মৃত্যুর বাস্তবতায় একসময় আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন
মুক্তিযুদ্ধের শেষ প্রত্যক্ষদর্শীও। কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মকে জানতে হবে
বাংলাদেশের সর্বোচ্চ গৌরবের সে ইতিহাস। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রেখে যাওয়ার প্রয়োজন অনুভব করে বাংলাদেশ
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর গড়ে তুলেছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের একটি বিশাল সংগ্রহ।
মুক্তিযুদ্ধ
জাদুঘরে আছে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় সংগঠিত প্রায়
২৩ হাজারের মতো ঘটনার একটি সংগ্রহ। মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের
প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে এসব ঘটনা। তাই এগুলোকে বলা
হচ্ছে ‘ওরাল হিস্ট্রি’ বা মৌখিক ইতিহাস। ওরাল হিস্ট্রি হলো যেকোনো ঘটনার
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অডিও, ভিডিও, কাগজে লিখে, কম্পিউটারে বা অন্য
যেকোনো মাধ্যমে সংরক্ষণ করা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক
মুনতাসির মামুন বলেন, ইতিহাস রচনায় মৌখিক ইতিহাস বা ওরাল হিস্ট্রি একটি
গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর স্থানীয়ভাবে যে মৌখিক ইতিহাস
সংগ্রহ করছে সেগুলো প্রত্যেক এলাকার আঞ্চলিক ইতিহাস হয়ে উঠছে।
মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে এ আঞ্চলিক
ইতিহাস।
প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা থেকে মৌখিক ইতিহাস সংগ্রহের এ কাজটি
প্রথম বাংলা একাডেমি শুরু করে বলে জানান ইতিহাস গবেষক আফসান চৌধুরী। তিনি
বলেন, ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বাংলা একাডেমি এ কাজটি করে। বাংলাদেশ
মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্রের ৭ম খণ্ডে বাংলা একাডেমির এসব সংগ্রহ লিপিবদ্ধ করা
আছে। তিনি জানান, এরপর প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এ ধরনের ইতিহাস সংগ্রহের কোনো
কাজ না হলেও ব্যক্তিগতভাবে কিছু কাজ হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের
শিক্ষা কর্মসূচির প্রকল্প সমন্বয়কারী রণজিত কুমার বিশ্বাস জানান, ২০০৪ সাল
থেকে শুরু হওয়া এ কার্যক্রমের মাধ্যমে বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় ৫৫টি
জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংগৃহীত হয়েছে।
ভ্রাম্যমাণ মুক্তিযুদ্ধ
জাদুঘর ঢাকার বাইরে জেলা ও উপজেলার বিভিন্ন স্কুলে গিয়ে ঢাকায় অবস্থিত
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের বিভিন্ন জিনিস প্রদর্শন করে। প্রদর্শনীর পর স্কুল
শিক্ষার্থীদের বলা হয়, বাড়ির বা আশপাশের যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ প্রত্যক্ষ
করেছেন তাঁদের কাছ থেকে সে সময়ের বিভিন্ন ঘটনা শুনে তা লিখে একজন শিক্ষকের
মাধ্যমে ঢাকায় পাঠাতে। লিখিত ঘটনার মধ্যে বর্ণনাকারীর নাম, বয়স ও
মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর অবদান উল্লেখ থাকে। হাতে লেখা এসব ঘটনা পাওয়ার পর
তা যাচাই বাছাই করা হয়। সত্যতা নির্ণয় করা হয় বিভিন্ন মাধ্যমের
সাহায্যে। এরপর সেগুলো সংরক্ষণ করা হয়। সাধারণত তিনভাবে ঘটনাগুলোকে
সংরক্ষণ করা হয়, হাতে লেখা কপি, কম্পিউটার কম্পোজ এবং বই আকারে।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সংগৃহীত মৌখিক ইতিহাসগুলো দিয়ে এ পর্যন্ত তিনটি বই
প্রকাশ করা হয়েছে।
রণজিত কুমার বিশ্বাস বলেন, সংরক্ষণের এ পদ্ধতির
মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের ওই ব্যক্তি, স্কুলশিক্ষক ও শিক্ষার্থী—এ তিন
প্রজন্মকে একই সঙ্গে যুক্ত করা হয়। তিনি বলেন, পরবর্তী প্রজন্মের কাছে
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পৌঁছানো ও মুক্তিযুদ্ধের গবেষকদের সাহায্য করাই এ
প্রকল্পের উদ্দেশ্য। এগুলোকে সরাসরি ইতিহাস না বলে আমরা ইতিহাসের উপকরণ বলে
গণ্য করছি।
প্রায় ২৩ হাজার মৌখিক ইতিহাসের সংগ্রহশালা নিঃসন্দেহে একটি
বড় সংগ্রহ। এটা স্বীকার করলেন জর্জিয়া স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস
বিভাগের ‘ওরাল হিস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের’ নির্বাহী পরিচালক ক্লিফ কুন। এ
বিষয়ে ই মেইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘কোনো একটি একক ঘটনাকে কেন্দ্র
করে এটি অনেক বড় একটি সংগ্রহ। বিশ্বের এ ধরনের অন্যান্য সংগ্রহের মধ্যে
নিঃসন্দেহে এটি বড় সংগ্রহের তালিকার প্রথম দিকেই থাকবে।’