খুব ছোট এয়ারপোর্ট।
সাদামাটা সাজানো। কিন্তু পারিপাট্যের অভাব নেই। পাসপোর্ট এগিয়ে দিতেই
ভিসা হয়ে গেল। কোন হোটেলে উঠছি, জেনে নিল মিষ্টি মেয়েটি।
আমাদের
চারজনের দলের শুধু আমিই আগে একবার ভুটানে এসেছিলাম। তাই এবার সাহস করে কারও
সাহায্য ছাড়া নিজেরাই চলে এসেছি। ই-মেইলে হোটেল, গাড়ি বুক করা হয়েছে।
অন্তর্জালেই ঠিক হয়েছে আমাদের সফরের মানচিত্র।
ছয় দিন থাকা। দুদিন রাজধানী থিম্পু, দুদিন পুনাখা আর দুদিন পারো। শেষ দিনে উড়াল।
এয়ারপোর্ট থেকে বের হওয়ার সময় ট্যাক্সিচালকদের মৃদু হাঁকডাক। আমরা তাঁদেরই জিজ্ঞেস করলাম, ‘মি. টবগেই কি এখানে আছেন?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, দেখেছি ওকে।’ বললেন একজন। অন্যজন ততক্ষণে টবগেইকে খুঁজে দিতে আমাদের পিছু নিয়েছেন।
হুম! বেশ লম্বা-চওড়া এক ভদ্রলোক ভুটানের জাতীয় পোশাকে এগিয়ে এলেন আমাদের দিকে। হিন্দিতে বললেন, ‘এসে পড়লেন তাহলে!’
ঢাকা
থেকেই মি. টবগেইয়ের সঙ্গে ফোনে আমরা রোডম্যাপ করে নিয়েছিলাম। বলেছিলাম,
আপনিই আমাদের চালক, আপনিই আমাদের গাইড। তাতে খুব খুশি হয়েছিলেন তিনি। বছর
পঞ্চাশের এই ভদ্রলোক তাঁর জিপটি নিয়ে এলেন। দেখা গেল, যথেষ্ট সুপরিসর
গাড়িটি। সুটকেসগুলো একদম পেছনে রেখে টবগেইয়ের পাশে একজন আর পেছনে তিনজন
অনায়াসে বসা যায়। গাড়িতে উঠে আমরা থিম্পুর দিকে চললাম। পারো শহরটি
ছাড়িয়ে যাওয়ার আগে থেকেই পারো চু আমাদের পিছু নিয়েছিল। সেটা এখন পাশে
পাশে বয়ে যাচ্ছে।
শুরুতে ‘ধড়ে প্রাণ ফিরে এল’ কেন বলেছিলাম, তার
ব্যাখ্যা করা দরকার। ভুটান বিশাল বিশাল সব পাহাড়কে নিয়ে গড়া দেশ। রাজধানী
থিম্পুতে বিমানবন্দরের রানওয়ে নির্মাণের জন্য একখণ্ড সমতল ভূমি পাওয়া
যায়নি। তাই পারো শহরে গড়া হয়েছে বিমানবন্দর। পৃথিবীর বিপজ্জনক
রানওয়েগুলোর মধ্যে পারোর অবস্থান বেশ ওপরের দিকেই, কারণ এই বিমানবন্দরে
অবতরণ করতে হলে দুটো পাহাড়ের মধ্য দিয়ে বিমান চালাতে হয়। এ জন্য পাইলটের
প্রয়োজন নিখুঁত প্রশিক্ষণ।
চু
শব্দের অর্থ নদী। পারো চু নদীটিই থিম্পুর কাছে গিয়ে হলো থিম্পু চু। খণ্ড
খণ্ড পাথরের ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে নদীর কাকচক্ষু জল। শীতকালে নদীতে পানি খুব
কম, স্রোতও কম, কিন্তু সেই স্রোতের শব্দই এখন একমাত্র শব্দ। ভুটান
প্রকৃত অর্থেই নীরব, নির্জন। মানুষ বা যানবাহনের ভিড়ভাট্টা একেবারেই নেই।
পাহাড়ে পাহাড়ে সাজানো ছবির মতো দেশটির রাজধানীটিতে বিলাসবৈভবের কোনো
চিহ্ন নেই। পাঁচতলার ওপর বাড়ি গড়ার অনুমতি মেলে না। ভুটানি স্টাইলে তৈরি
বাড়িগুলো এখনো স্বকীয়তা হারায়নি। পশ্চিমা দানবের দল এখনো ভুটানের
আত্মাকে কবজা করতে পারেনি।
পারো থেকে দেড় ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে
থিম্পু। নির্জনতা ফুঁড়ে মাঝে মাঝে স্কুলগামী শিশুদের কিচিরমিচির, কখনো
রাস্তা মেরামতকর্মীদের ছাড়া আর কারও দেখা মিলছে না। তবে থিম্পুর কাছাকাছি
দু-তিনটি পাহাড়ি বাঁকে ফল নিয়ে বসে আছেন কিছু নারী। বুনো আপেল আর রসাল
কমলা দেখে কার না লোভ লাগবে? ফলে তাজা ফলের স্থান হলো আমাদের গাড়িতে।
থিম্পুর
এক কোণে বিশাল এক পাহাড়ের ওপর আমাদের ঠিকানা—জামবিয়াং রিসোর্ট।
পাহাড়ের গায়ে খাঁজকাটা বাঁধানো সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হয় রিসোর্টে। প্রতি
বাঁকেই দুটি বা তিনটি ঘর, তারপর আবার ওপরে ওঠা, আবার কয়েকটি ঘর।
রিসোর্টের
রেস্তোরাঁয় ভুটানি খাবারের খোঁজে হুমড়ি খেয়ে পড়ি। ‘এমা ডাটশি’ নামে
খাদ্যটির অর্ডার দেওয়া হলে লাল চালের ভাত আর পনিরে জড়ানো বড় বড় সবুজ
মরিচ এনে হাজির করা হয়। ভাতের সঙ্গে এই বস্তুটি মিলিয়ে মুখে দিতেই অসাধারণ
এক স্বাদে মন জুড়িয়ে যায়। জাশা মারুর স্বাদবঞ্চিত হই না আমরা। ভুটানি
মোমোর স্বাদ লাগতে দিই জিবে। পরবর্তী দিনগুলোয় চায়নিজ আর কন্টিনেন্টাল
ডিশের পাশাপাশি ভুটানি খাবারও আমাদের রসনা তৃপ্ত করে।
মি. টবগেই ঠিক করে
রেখেছিলেন এক দিনেই থিম্পু শহরটা ঘুরিয়ে দেখাবেন। তাই দ্বিতীয় দিন সকাল
১০টার দিকে আমরা বের হয়ে পড়ি। নির্জনতাই কথা কইছিল আমাদের সঙ্গে, শুধু
মাঝে মাঝে থিম্পু চুর গর্জন শোনা যাচ্ছিল। একটি মন্দিরে কিছুটা সময়
কাটানোর পর পাহাড়ি পথে এবারের গন্তব্য ‘বুদ্ধাস পয়েন্ট’। বিশাল এক
পাহাড়ের ওপর সোনালি বুদ্ধকে থিম্পু শহরের যেকোনো প্রান্ত থেকেই দেখা
যায়। বুদ্ধাস পয়েন্টে অনেক পর্যটক। স্থাপত্যটি, এই খাদ, এই পাহাড়ের পর
পাহাড় বুঝিয়ে দেয় জগতের বিশালতা আর এই বিশালতার পাশে মানুষ কত ক্ষুদ্র!
এরপর
থিম্পু চিড়িয়াখানা, ক্লক টাওয়ার, হস্তশিল্পের সারিবদ্ধ দোকান হয়ে
রিসোর্টে ফিরে আসা। পথজুড়েই থিম্পু চু আমাদের সঙ্গ দেয়। দুপুরে একটি
ভারতীয় হোটেলে খেতে গিয়ে ডাল, মুরগির দোপেঁয়াজা, সবজি আর সাদা ভাত পেয়ে
বর্তে যাই। বুঝতে পারি, এ যাত্রায় ভ্রমণটা হবে তোফা। পরদিনই পুনাখার পথে
যেতে হবে। থিম্পু থেকে ৭৭ কিলোমিটার পথ। পথে পড়বে দোচলা। মি. টবগেই
বলেছেন, পথের মাঝখানে দোচলা বলে একটি জায়গা আছে, সেখানে এখন তুষারপাত
হয়েছে। আমাদের দলের সর্বকনিষ্ঠ সদস্যের মন এ খবরে চনমনে হয়ে ওঠে। এই
পরিবারে ওই একমাত্র আদম সন্তান, যে এখনো তুষারপাত দেখেনি।
আমরা স্নিগ্ধমনে পুনাখা যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকি।