কক্সবাজারের কলাতলী। হোটেল অ্যালবাট্রসে উঠি আমরা ৫৪ জনের এক বিশাল বাহিনী। প্রথম দিনটি কাটল পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠে-নেমে, বালুময় সৈকতে পা ডুবিয়ে হেঁটে আর গোসলের ছলে সাগর জলে দুরন্তপনায় মেতে। রাতে হঠাৎই সিদ্ধান্ত হলো পরদিন আমরা এক নির্জন দ্বীপে রওনা হচ্ছি।
নাম তার সোনাদিয়া দ্বীপ।
যাত্রা হলো শুরু
পরদিন
খুব সকালেই নাশতা সেরে বেরিয়ে পড়ি আমরা। হোটেলের সামনে থেকেই দলে দলে
অটোতে চেপে আমরা ছুটছি ৬ নম্বর ঘাটে। রাস্তা অতটা প্রশস্ত নয়, বাসের দেখা
নেই বললেই চলে, শুধুই অটোর রাজত্ব।
ঘাটে আমাদের সদলবলে আসতে দেখে এগিয়ে
এলেন কজন ঘাটের মাঝি। স্বাগত জানাতে নয়, বরং আমদের যাত্রা ওখানেই থামাতে!
তাঁদের কথা, ‘এই ঘাটে এখন ভাটা পড়ে আছে। জোয়ারের পানি ছাড়া নৌকা
ভাসানো সম্ভব না।’ অগত্যা কী আর করা। তাঁদের পরামর্শে আমরা ফের ছুটলাম
কস্তুরি ঘাটে।
চলল নৌকা দুলে দুলে
পিচঢালা পথ
ছেড়ে ইটগাঁথা পথ। দুপাশে হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে থাকা ঝোপ ঝোপ ম্যানগ্রোভ
গাছগাছালি। সেসব ছাড়িয়ে, কাঠের সাঁকো মাড়িয়ে, পরপর কাদায় বিছিয়ে রাখা
ডিঙি নৌকা ডিঙিয়ে উঠে বসলাম আমাদের কাঙ্ক্ষিত নৌকায়। তীর ঘেঁষে অসংখ্য
নৌকা আর স্পিডবোট নোঙর করা। ডাঙায় বরফকল—বরফভাঙার বিকট শব্দ আসছে ভেসে।
মাথার ওপর উড়ন্ত গাংচিলের সঙ্গ নিয়ে আমাদের নৌকা যাত্রা করল শুরু।
সোনাদিয়া সৈকতে
দেড়
ঘণ্টা জার্নি বাই বোট শেষে আমরা ধুপ ধাপ লাফিয়ে পড়লাম সোনাদিয়া সৈকতে।
নেমেই চক্ষুস্থির, জেলেদের অতি ব্যস্ত কাণ্ডকারখানা দেখে। ঘাটে নোঙর করা
মাছভর্তি নৌকা। মাছে মেশানো হচ্ছে লবণ। মুহূর্তেই ঝুড়ি ভর্তি হয়ে ডাঙায়
উঠছে সে মাছ। সাদাটে চিংড়ি, পোয়া আর লইট্টা মাছের সংখ্যাই বেশি। ধরা
পড়েছে স্টিংরে মাছও (শাপলাপাতা মাছ)।
পাড়ে খড় আর ছনের ছাউনিতে ছাওয়া
কয়েকটি দোকান। এর আশপাশে সুবিশাল শুঁটকিরাজ্য। বাঁশে ঝুলিয়ে আর মাচায়
ছড়িয়ে চলছে শুঁটকি তৈরির কাজ।
আমরা হাঁটছি পানি ছুঁই ছুঁই বালুময় সৈকত
ধরে। এটা কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন কিংবা ছেঁড়াদ্বীপের মতো নয়, নিরিবিলি
এই বেলাভূমিতে পর্যটক বলতে শুধুই আমরা। সৈকতে ছড়ানো শামুক-ঝিনুকের
আস্তরণ।
খানিক বাদেই চোখ ধাঁধিয়ে যায় রুপালি বালুর লাল শাড়ি দেখে! এ
যে শত শত লাল কাঁকড়ার ঝাঁক। পিঠের অ্যান্টেনা-চোখে চেয়ে, আমাদের আগমন টের
পেয়ে, মেতে ওঠে লুকোচুরি খেলায়। হয় ঝাঁপ দেয় সাগরজলে, না হয় লুকায় বালুর
তলে।
সৈকতের বিপরীতে সারি সারি ঝাউবন, আমরা কজন উঁকি দিতে গেলাম
লোকালয়ের খোঁজে। পেলাম সৈকতের শেষ মাথায় একটি কচ্ছপের হ্যাচারি, রাতে
পেড়ে যাওয়া ডিম সংগ্রহ করে বাচ্চা ফোটানো হয় তাতে। বেড়ে ওঠা সে বাচ্চা
আবার সাগরে ছেড়ে দেওয়া হয়।
কচ্ছপের হ্যাচারির পরই মিলল লোকালয়ের দেখা।
আঞ্চলিক ভাষা বুঝতে সমস্যা হলেও, কিশোর দুই যমজ ভাই শামীম ও রিয়াজের
সঙ্গে গল্প হলো বেশ। ডাবের পানির আপ্যায়নও জুটল। ফিরতি পথে অনেকটা দূর
এগিয়ে দিয়ে গেল দ্বীপের একদল ছোট্ট শিশু, আবার হাত নেড়ে এও বলল, আবার
আইসেন।
যেভাবে যাবেন
কক্সবাজারের কলাতলী (লাবণী
বিচের বিপরীতে) থেকে জনপ্রতি ১০ টাকা অটো ভাড়ায় চলে আসুন ৬ নম্বর ঘাট বা
কস্তুরি ঘাটে। সেখান থেকে জনপ্রতি ১৫০ টাকা নৌকা বা ৭৫ টাকা স্পিডবোট
ভাড়ায় পৌঁছে যাবেন সরাসরি দ্বীপে। নির্জন দ্বীপ, তাই দলবলে যাওয়াই ভালো।
সোনাদিয়ায় থাকার ব্যবস্থা নেই। খুব সকালে বেরিয়ে দিনের আলো থাকতে ফিরে
আসাই ভালো।