এবারের প্ল্যানটা হুট করেই হয়ে
গেল। কাঁধের ছোট্ট ব্যাগটিতে একটা মোটাসোটা ‘কম্বল’ ভরেই রওনা দিলাম
চট্টগ্রাম। সকাল নয়টার গাড়ি আমাকে বিকেল পাঁচটায় নামিয়ে দিল সীতাকুণ্ড
বাজারে। ইকোপাকের্র গেটটা পার হয়ে দেখি, সেখানে আগে থেকেই হাসিমুখে আমার
জন্য অপেক্ষা করে আছে অনেকগুলো চেনা মুখ—অপু ভাই, লিমন ভাই, রুপা আপু,
আরমান ভাই ও রুবা আপু।
বিশাল বিশাল ব্যাগ নিয়ে সবাই হাঁটা শুরু
করেছে, হাতে রাতের খাবারের জন্য বাজার সদাই, কী নেই তাতে! খিচুড়ি রাঁধার
ডাল থেকে শুরু করে সালাদ বানানোর টমেটো পর্যন্ত রয়েছে, সেগুলোর ভিড়ে আবার
থলে থেকে উঁকি দিচ্ছে চট্টগ্রাম থেকে বয়ে আনা মুরগির মাংস।
সীতাকুন্ড
পাহাড়ের পথে হাঁটতে হাঁটতে চোখ রাখলাম এক্কেবারে ওপরের পাহাড় চূড়াটায়,
আর পা চালালাম সবুজ কেটে কেটে তৈরি করা একমাত্র মাটির রাস্তাটি ধরে। সে
রাস্তা সাপের মতো এঁকেবেঁকে ঝুপ করে গিয়ে পড়েছে পাথুরে ঝিরিতে, সেটা
দিয়ে নিশ্চিন্তে বয়ে চলেছে পৌষের শীতের ঊষালগ্নে হাড় কাঁপিয়ে দেওয়া
ঠান্ডা পানি! একেকবার একেকজনের পা পড়ে সেই পানিতে আর গগনবিদারী আওয়াজে
ভরে ওঠে বনের এমাথা-ওমাথা।
দিনের আলো যখন আমাদের একাকী করে তারার দেশে
রেখে গেল, ঠিক সে সময় দেখা মিলল আমাদের কাঙ্ক্ষিত জায়গার। এখানেই আমরা
তাঁবু খাটাব আজ রাতে, মোমের আলোতে ভাসিয়ে দেব পাহাড়ি ঝরনার ক্ষীণ
স্রোতগুলোকে, আর কনকনে বাতাসে কাঁপতে কাঁপতে গলা ছেড়ে গাইব স্বরচিত কোনো
গান। অন্ধকারে যখন আমাদের হাতের তালু ছাড়া নিকটবর্তী আর কিছুই দেখা যাচ্ছে
না, ঠিক সে সময় আমরা হাঁচড়েপাঁচড়ে উঠে পৌঁছালাম পাহাড়ের এক্কেবারে
চূড়ায়, এখান থেকে একনিঃশ্বাসে পুরো ঝরনাটা দেখা যায়, বর্ষাকালে চারপাশের
বন, পাহাড় আর বাতাস কাঁপিয়ে যেই ঝরনাটা নেমে আসে—সেখানে এখন হেলেদুলে
বয়ে চলেছে রুগ্ণ পানির ধারা। এই জায়গার নাম সুপ্তধারা ঝরনা।
ক্যাম্পিং
করার প্রথম শর্তই হলো তাঁবু ফেলার জন্য ভালো ও আরামদায়ক একটা জায়গা
খুঁজে বের করা। দ্বিতীয় শর্ত হলো খাবার রান্নার জন্য আগুনের ব্যবস্থা করা,
আর তৃতীয় শর্ত হলো আয়েশ করে আসমান দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে যাওয়া। সুতরাং
বসে থাকলে তো আমাদের হবে না, বিরাট বিরাট সব পাথর পড়ে আছে আমাদের সামনে,
দুনিয়ার আর সব মানুষের কাছে এগুলো সামান্য পাথর হলেও আমাদের চোখে তখন
এগুলো জলজ্যান্ত একেকটা বিছানা, কোন পাথরে কোন তাঁবু ফেলা হবে, তাই নিয়ে
জল্পনাকল্পনা আর গবেষণায় স্রোত বয়ে গেল মিনিট পাঁচেক। টপাটপ করে সবার
ব্যাগ থেকে বের হতে লাগল ভ্রাম্যমাণ ঘর, এদের মধ্যে একটা তাঁবু আবার
বিশালতার দিক দিয়ে সবাইকে ছাড়িয়ে গেল, যখন সেটাকে দাঁড় করানো হলো তখন
সে রীতিমতো একটা বিশাল ঘরে পরিণত হলো, যেখানে অনায়াসেই আটজন হাত-পা মেলে
ঘুমাতে পারবে। তাঁবুর গায়ে বাবর আলী নেপাল থেকে নিয়ে আসা প্রেয়ার
ফ্ল্যাগ লাগিয়ে দিল কয়েকটা।
আমি হাঁ করে তাঁবুর দিকে তাকিয়ে থাকতে
থাকতেই দেখি পোলাপাইন সব গায়েব! কেউ চলে গেল লাকড়ি জোগাড় করতে, আগুন
জ্বালাবে। আর কেউ গেল স্টোভ জ্বালাতে, কফি বানাবে। সবাইকে বুড়ো আঙুল
দেখিয়ে ভয়াবহ ঠান্ডা পানিতে খাবারদাবার কাটাকুটি করতে বসে গেল রুপা দিদি!
যে পানি দূর থেকে দেখলেই ঠান্ডায় গায়ের রোম দাঁড়িয়ে যায়, সেই পানিতে
অবলীলায় তিনি মুরগি, পেঁয়াজ, টমেটো কেটে আবার চাল, ডালও ধুয়ে ফেললেন!
ওদিকে সবার পেটে তখন ছুঁচোর নাচন—লাকড়ি রেডি, রান্না করার জন্য খাবার
রেডি, পিপাসা মেটানোর জন্য ঝরনার অঢেল পানি রেডি, আর কিসের চিন্তা। এবার
জ্বালাও আগুন!
রান্না চড়িয়েছেন রুমী ভাই, তাঁকে সার্বক্ষণিক সাহায্য
করছেন বুনো ভাই। এই দুজনের হাতের রান্না যেন শিল্প হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সবার
প্লেটে প্লেটে। এতগুলো প্লেটও আসলে আনা হয়নি! ফলে কেউ খেতে বসল কুমিল্লা
থেকে নিয়ে আসা সন্দেশের প্যাকেটে, আবার কেউ খেতে বসল পাতিলের ঢাকনা উল্টো
করে। এদের সবাইকে ছাড়িয়ে গেলেন আরমান ভাই, তিনি মগের মধ্যে খিচুড়ি-মাংস
ঢেলে লাল জ্যাকেট পরে বসে গেলেন কমলা আলোর কোলে।
রান্নার
স্বাদ এখনো মুখে লেগে রয়েছে, ফারহান ভাইয়ের কাছে রান্না এতই মজা লেগেছে
যে তাঁকে খিচুড়ির পাতিলের আশপাশ থেকে নড়ানোই যাচ্ছে না, শেষমেশ খোকন
কারিগর এসে তাঁকে পাঁজাকোলা করে তাঁবুতে নিয়ে শুইয়ে দিলেন, সঙ্গে দিলেন
পানির বোতল, উনি সারা রাত পানি খেয়েই পার করে দিলেন!
রাতের খাবারের পাট
চুকিয়ে আমরা সবাই মুখোমুখি হলাম আকাশের, সেখান হাজার তারার মেলা বসেছে।
সবাই সেজেছে আলোর সাজে। নিকষ আঁধারকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে সব কটা তারা যেন
আমাদের জন্যই কুয়াশাকে বিদায় করে দিয়েছে আজ, আজ তাদের অতিথিদের মুগ্ধ
করার রাত, আজ তাদের নিজেদের উজাড় করে আঁধার পৃথিবীটা আলোকিত করার রাত।
প্রতি ঘণ্টায় পাল্টে যাচ্ছে আকাশের দৃশ্যপট, তারার সারি ক্রমেই বাড়ছে,
দেখে মনে হচ্ছে রাতের সঙ্গে সঙ্গে ঘুমও ভাঙছে তাদের, একেকজন একটা একটা করে
চোখ মেলছে আর একটা একটা করে তারার জন্ম হচ্ছে ঘুটঘুটে কালো আকাশের গায়ে।
এবার
মোমবাতি জ্বালানো হবে। সবাই মিলে চললাম ঝরনার একেবারে কোলে, ঠান্ডা পানি
পায়ে মাড়িয়ে এসে থামলাম পাহাড়ের বুকের মাঝে, প্যাকেট থেকে একের পর বের
করা হলো মোমবাতিগুলো। বসানো হলো নির্দিষ্ট দূরত্ব পর পর। মিনিট খানেক
নীরবতা, সবাই চুপ, সবকিছুই যেন স্থবির।
এরপরই অপু, লিমন বড়ুয়া, বাবর
আলী, বুনো, দিদার আর ফারহান ভাইয়ের হাতের ছোঁয়ায় জ্বলে উঠতে লাগল মোমের
শিখা, একের পর এক। পুরো ঝরনাজুড়ে তিরতির করে চলছে হাজার খানেক মোমের আলোর
নাচন! মুহূর্তেই কালো পাহাড় ভরে গেল সোনালি আলোর ছটায়, সে আলোতে প্রাণ
পেল ঝরনার পানি। আকাশজুড়ে মিটমিট করতে হাসতে থাকা তারার দলও ম্রিয়মাণ
হয়ে যায় টিমটিমে জ্বলতে থাকা এই মোমের শিখার কাছে। তোড়জোড় শুরু হলো
ক্যামেরা নিয়ে। একসময় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা এই আমাদের চোখের সামনেই গলে
গলে থেমে গেল সোনালি আলোর নাচন। রাত তখন দেড়টা। আবার হেসেছে তারার মিছিল।
আর আমরা ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়লাম তাঁবুর ঘরের ঠান্ডা পাথুরে বিছানায়,
সারা রাত পৌষের শীত ছুরি চালাল কম্বলের বাইরে থাকা শরীরের অংশে। আর সবকিছু
রয়ে-সয়ে আমরা চোখ বন্ধ করলাম গহিন অরণ্যে, তারার বিছানার ঠিক উল্টো দিকে।
পাহাড়ে ক্যাম্পিং করার সময় একটা জিনিস মাথায় রাখবেন, কোনো অপচনশীল
জিনিস (পলিথিন, প্লাস্টিকের বোতল, প্লাস্টিকের প্যাকেট) ফেলে আসবেন না।
এগুলো পুরো পরিবেশকে বিষিয়ে তুলবে। মলমূত্র এমন জায়গায় ত্যাগ করবেন,
যেখানে পানির সংস্পর্শ থাকবে না, এতে করে ঝরনার পানি দূষিত হবে না। পাহাড়ে
গিয়ে কাঁচা গাছ কাটবেন না, কোনো পশুপাখি হত্যা করবেন না। সবচেয়ে বড়
কথা—চিৎকার-চেঁচামেচি করবেন না, এটা জঙ্গলের প্রাণীদের আস্তানা, আমাদের
চিৎকার-চেঁচামেচিতে সবচেয়ে বড় অসুবিধা হয় তাদেরই। আর পাহাড়ে অনেক
ঠান্ডা, কাজেই রাতে ক্যাম্পিং করতে গেলে গরম কাপড় অবশ্যই নিয়ে যাবেন,
সঙ্গে একটা তাঁবু।
যেভাবে যাবেন
যেভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে যেকোনো চট্টগ্রামের গাড়িতে
উঠে সীতাকুণ্ডে নেমে পড়বেন, সেখানে এস কে এম জুট মিলের রাস্তা ধরে
রেললাইন পার হয়ে ঝিরিপথে হাঁটা দেবেন পাহাড় লক্ষ্য করে। ৪০ মিনিট পর
নিজেদের আবিষ্কার করবেন সুপ্তধারা ঝরনার নিচে, সেখান থেকে ডান পাশের পাহাড়
বেয়ে উঠে যাবেন ঝরনার ওপরে। এবার জায়গা বেছে আরাম-আয়েশ করে তাঁবু ফেলে
কাটিয়ে দিতে পারেন অসাধারণ একটা রাত।