মার্চ-এপ্রিলে প্রবাহ থাকে ৫৮৮৭ কিউসেক। গতকাল ছিল মাত্র ৩৫০ কিউসেক
তিস্তার পানিপ্রবাহ সর্বকালের সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে। ঐতিহাসিকভাবে
মার্চ-এপ্রিল মাসে তিস্তায় পানিপ্রবাহ থাকে ৫ হাজার ৮৮৭ কিউসেক। সেখানে
গতকাল পানি প্রবাহ ছিল ৩৫০ কিউসেক, আগের দিন মঙ্গলবার পানিপ্রবাহ ছিল ৪০০
কিউসেক। গত বছর ফেব্রুয়ারি - মার্চ মাসে পানিপ্রবাহের গড় ছিল ৫৫৩ কিউসেক।
এদিকে, ২০১৩ সাল এবং তার আগের বছরগুলোতে একইসময়ে পানিপ্রবাহ ছিল ২৪০০
কিউসেক থেকে ৩৫০০ কিউসেক। পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে প্রাপ্ত এ তথ্য থেকে বোঝা
যাচ্ছে গত বছর থেকে পানিপ্রবাহ মারাত্মকভাবে কমে গেছে। পানি বিশেষজ্ঞরা
বলছেন, উজান থেকে একতরফা পানি প্রত্যাহারের কারণেই এমনটা হচ্ছে।
তিস্তা ব্যারেজ পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, ফেব্রুয়ারি মাসেও
তিস্তার পানি প্রবাহ সর্বনিম্ন পর্যায়ে ছিল। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন
কর্মকর্তা বলেন, ৩৫০ কিউসেকের বেশি হবে না। তিনি আরও বলেন, আর ওয়ান টি
ক্যানেলে পানি বন্ধ থাকায় সিলট্রাপে পানি জমা রয়েছে তবে প্রবাহ নেই বললেই
চলে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান সরাসরি উত্তর
না দিলেও সর্বনিম্ন প্রবাহের কথা স্বীকার করে বলেন, বুধবার পানির পরিমাণের
কোন তথ্য তার জানা নেই। তবে সাড়ে ৩শ কিউসেক হতে পারে।
এই পানি
প্রবাহ কমে আসায় কৃষিকাজ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মারাত্মকভাবে। তিস্তা নদীর ওপরে
নির্ভরশীল কৃষকদের জীবনে নেমে এসেছে বিপর্যয়। অপরদিকে, তিস্তা নদী পানি
শূন্য হয়ে নদীর উজান ও ভাটিতে জেগে উঠেছে ধু-ধু বালুচর। দেশের সর্ববৃহত্
সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারেজ গত এক মাস থেকে চরম পানি সংকটে পড়েছে। চলতি রবি
ও খারিপ-১ মৌসুমে ২৮ হাজার ৫শ হেক্টর জমিতে সেচ প্রদানের টার্গেট করা হলেও
বর্তমানে যে পরিমাণ পানি রয়েছে তাতে মাত্র ১ হাজার ৫শ হেক্টর জমিতে সেচ
দেয়া সম্ভব। তিস্তা ব্যারেজে সিল্টট্রাপ থেকে ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত তুহিন
বাজার প্রধান সেচ ক্যানেলের আর ওয়ান টি ক্যানেলে পানি বন্ধ করে দিয়েছে
পাউবো কর্তৃপক্ষ।
ব্যারেজ এলাকা ঘুরে দেখা যায়, এস থ্রি টি শাখা
ক্যানেল রয়েছে পানি শূন্য। উক্ত ক্যানেলের ২শ হেক্টর জমির মধ্যে সেচ
ক্যানেলের মাধ্যমে ২০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের চারা রোপণ করা হয়েছে। এস
থ্রি টি শাখা ক্যানেল সভাপতি সামচুল হক জানায়, ২০ হেক্টর জমিতে সেচ
ক্যানেলের পানির জন্য ১ম কিস্তিতে ৩৫ হাজার টাকা জমা প্রদান করা হয়েছে।
অবশিষ্ট ৭০ হাজার টাকা ব্যাংকে জমা দেয়ার জন্য পাউবো কর্তৃপক্ষ নির্দেশ
দিলেও পানি না থাকায় কৃষকরা টাকা দিচ্ছে না। অবশিষ্ট জমিতে অগভীর নলকূপের
মাধ্যমে বোরো চারা রোপণ করা হয়।
প্রধান ক্যানেলে পানি কম থাকার
কারণে শাখা ক্যানেলে পানি পাচ্ছে না কৃষকরা। পাউবো কতৃপক্ষ বলছে দিন দিন
পরিস্থিতি আরও অবনতি হতে পারে।
এই সমস্যা সমাধানে তিস্তা নদীর
পানিবণ্টন চুক্তির বিকল্প নেই বলে উল্লেখ করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন,
দুদেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিরাজ করছে। এ অবস্থায় তিস্তা পাড়ের
মানুষের দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে যত দ্রুত সম্ভব পানি বণ্টন চুক্তি
সম্পন্ন করা প্রয়োজন। তাহলে মানুষের জীবনের এ বিপর্যয় রোধ করা সম্ভব।
সেজন্য যৌথ নদী কমিশনের নিয়মিত বৈঠক হওয়া জরুরি। কিন্তু সেটা হচ্ছে না।
এদিকে, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন,
২০১০ সালের মার্চ মাসের পরে যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) কোন বৈঠক হয়নি। ২০০১
সালে যৌথ নদী কমিশনের ৩৪তম সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল বছরে ৪টি, কমপক্ষে
বছরে ২টি বৈঠক হবে। কিন্তু এরপরে ২০০৩ সালে, ২০০৫ সালে এরপর পাঁচ বছর পরে
২০১০ সালের মার্চে শেষ বারের মত জেআরসি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
পানি
উন্নয়ন বোর্ড বলছে, ভারতের পানি সম্পদ মন্ত্রী উমা ভারতীকে বাংলাদেশে
আমন্ত্রণ জানিয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। তারাও পাল্টা চিঠিতে বাংলাদেশে আসার জন্য
প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে অবহিত করছেন। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন,
ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের তিস্তা চুক্তির বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও
তা পিছিয়ে যাওয়ায় এক ধরনের অস্বস্তি বিরাজ করছে। সে কারণেই নিয়মিত জেআরসি
বৈঠক হচ্ছে না। তবে সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা
বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাংলাদেশ সফর ও সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র
মোদীর সঙ্গে মমতার বৈঠকে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আলোচনা তিস্তা চুক্তির বিষয়ে
আশার আলো ছড়াচ্ছে মানুষের মাঝে।
এ প্রসঙ্গে ওয়ারপোর সাবেক
মহাপরিচালক ম ইনামুল হক বলেন, উজান থেকে পানি প্রত্যাহার করা না হলে এই
পানি প্রবাহ কমে যাওয়ার কোন যৌক্তিক কারণ নেই। দুই বছর আগে যে প্রবাহ ছিল
সেই প্রবাহ এখন নেই। তিনি বলেন, তিস্তার পানি মূলত প্রত্যাহার করে ডাহুক ও
মহানন্দা দিয়ে বিহারের মেতি নদীতে পাঠানো হচ্ছে। এছাড়া কিছুটা ব্যবহার
হচ্ছে সেচ প্রকল্পে। প্রত্যাহার করা হচ্ছে এতে কোন সন্দেহ নেই। তিস্তা
পাড়ের মানুষের বিপর্যয় রোধে যত দ্রুত সম্ভব তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তি কার
প্রয়োজন বলে মত দেন তিনি।
তবে, এই চুক্তি না হওয়ায় আর পর্যাপ্ত
পানিপ্রবাহ না থাকার কারণে তিস্তা পাড়ের মানুষ সম্মুখীন হচ্ছেন অপরিসীম
দুর্ভোগের। পানির অভাবে কৃষি কাজ ব্যাহত হওয়ায় তাদের জীবন-জীবিকা প্রত্যক্ষ
হুমকির সম্মুখীন। বুধবার সরেজমিনে তিস্তা প্রকল্প এলাকা ও নদী শিকস্তি
অঞ্চল ঘুরে দেখা যায়, পানির অভাবে কৃষকরা দিশেহারা। খেতের ধান রোপণ
মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
তিস্তা নদীতে স্বল্প পানি
প্রবাহের উপর নির্ভর করে চলতি রবি ও খরিপ-১ মৌসুমে তিস্তা ব্যারাজের
মাধ্যমে সেচ কার্যক্রম ২১ জানুয়ারি শুরু করা হয়েছে। তবে এবার সেচ প্রদানে
রংপুর ও দিনাজপুর জেলার কমান্ড এলাকাকে সেচ সুবিধা থেকে বাদ রেখে সেচ
প্রদানের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। কৃষকদের চাহিদা অনুযায়ী সেচ নির্ভর
বোরো আবাদে পানি দিতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা।
জানা যায়, গত বছর
এই মৌসুমে নীলফামারী, রংপুর ও দিনাজপুর জেলার ৬৫ হাজার হেক্টরে সেচ সুবিধা
প্রদানের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। কিন্তু এবার তিস্তা নদীর পানি প্রবাহ কম থাকায়
গত বছরের চেয়ে এবারের চলতি রবি ও খারিপ-১ মৌসুমে সেচ প্রদানে জমির পরিমাণ
৩৭ হাজার ৫শ’ হেক্টর কমিয়ে আনা হয়েছে। এতে দিনাজপুর ও রংপুরের কমান্ড এলাকা
সেচ কার্যক্রম থেকে বাদ দিয়ে শুধু নীলফামারী জেলার ডিমলা, জলঢাকা,
নীলফামারী সদর ও কিশোরীগঞ্জ উপজেলার ২৮ হাজার ৫শ’ হেক্টর জমিতে সেচ
প্রদানের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে যে পানি পাওয়া যাচ্ছে
তাতে ডিমলা উপজেলার ৩টি ইউনিয়নের ১৫শ’ হেক্টর জমিতে সেচ দেয়া সম্ভব হবে।
সেচ সংকট নিরসনে পাউবো কর্তৃপক্ষ সেচ প্রদানে রেশনিং পদ্ধতি চালু করেছে।
তিস্তা বাঁচাও রক্ষা কমিটির সভাপতি ও খালিশা চাপানি কৃষক আতাউর রহমান
জানান, তিস্তা সেচ ক্যানেলের মাধ্যমে নামে মাত্র পানি সরবরাহ করা হচ্ছে।
প্রধান ক্যানেলে পানি না থাকায় সেচ ক্যানেলের উপকারভোগীদের চরম ভোগান্তিতে
পড়তে হচ্ছে। এস ওয়ান টি সেচ ক্যানেলের সভাপতি আমিনুর রহমান জানান, তার
ক্যানেলের ৭শ’ হেক্টর জমির মধ্যে মাত্র ২শ’ হেক্টর জমিতে সেচের পানি সরবরাহ
করা হচ্ছে।
সহ- সভাপতি সাহিদুল ইসলাম শেফা জানান, তিস্তার পানি
প্রবাহ যেভাবে কমতে শুরু করছে তাতে কমান্ড এলাকার কোন জমিতে সেচের পানি
দেয়া সম্ভব হবে না। পানির চাপ কম থাকার কারণে প্রধান সেচ খালে পানি থাকলেও
শাখা ক্যানেলে পানি যাচ্ছে না।
তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্পের
সম্প্রসারণ কর্মকর্তা রাফিউল বারী জানান, চলতি রবি ও খরিপ-১ মৌসুমে তিস্তা
ব্যারাজ কমান্ড এলাকায় আনুষ্ঠানিকভাবে সেচ প্রদান শুরু করা হয়। উজানের
প্রবাহ কম থাকায় বর্তমানে যে পানি রয়েছে তাতে করে মাত্র ১৫শ’ হেক্টর জমিতে
সেচ দেয়া সম্ভব হবে।