চলমান
রাজনৈতিক সংকট
সমাধানে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মহলের চাপ থাকলেও মূলত পাঁচ শর্তে আটকে আছে সংলাপ-সমঝোতা। এ শর্তগুলোয় রাজি না হলে বিএনপির সঙ্গে আপাতত সংলাপে বসার কোনো সম্ভাবনা নেই ক্ষমতাসীন
আওয়ামী লীগ সরকারের। আর এ কারণেই
আপাতত সমাধানের
পথও দেখছে না রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল।
সূত্রে জানা গেছে, সরকারের দেওয়া পাঁচ শর্তের মধ্যে রয়েছে- প্রথমত,
সমঝোতায় আসতে হলে
বিএনপিকে জামায়াত ছাড়তে হবে। কেননা সমঝোতার
লক্ষ্যে বিএনপির
সঙ্গে সংলাপে বসলে যুদ্ধাপরাধের বিচারপ্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। দ্বিতীয়ত,
পেট্রলবোমার
রাজনীতিসহ আন্দোলনের নামে সব
ধরনের
সংঘাত-সহিংসতা বন্ধ করতে হবে। তৃতীয়ত,
সংলাপে সম্মতির
ঘোষণার পরে সারা দেশে বিএনপি-জামায়াত তাণ্ডব চালাতে
পারে বলেও আশঙ্কা সরকারের। এ ধরনের
কোনো ঘটনা ঘটবে
না- তারও নিশ্চয়তা চায় সরকার। চতুর্থত,
চলমান সহিংস রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সরকারে থাকা আওয়ামী
লীগের প্রভাবশালী মন্ত্রী ও
মহাজোটের শীর্ষ
নেতাদের বিরোধিতা। পঞ্চমত, পুরনো ইস্যুগুলো সামনে চলে আসা। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতবার্ষিকীর
দিন ১৫ আগস্ট খালেদা জিয়ার জন্মদিন
পালন ও ২১ আগস্ট
গ্রেনেড হামলার মতো ঘটনাগুলো চলে আসা। সূত্রমতে,
সংলাপ চাইলে বিএনপিকে জামায়াত ছাড়তে হবে-
নিজেদের এমন অবস্থানে এখনো অটল সরকার।
আওয়ামী লীগের
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে শিগগিরই যুদ্ধাপরাধের বিচারপ্রক্রিয়া শেষ করতে
হবে। কারণ, যুদ্ধাপরাধের বিচারপ্রক্রিয়া সংলাপে বসলে বাধাগ্রস্ত হবে।আওয়ামী লীগ মনে করে, সংলাপে যাওয়ার আগে বিএনপি-জামায়াতকে পেট্রলবোমা, জ্বালাও-পোড়াওসহ সব ধরনের
সংঘাত-সহিংসতা
বন্ধ করতে হবে। এর কারণ হিসেবে দলটির বক্তব্য হলো,
বর্তমান যে সহিংসতা চলছে তার সঙ্গে
বিএনপি-জামায়াতের সম্পৃক্ততা রয়েছে। এ কারণে সংলাপে বসলে বিচারপ্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সহিংসতার সঙ্গে জড়িত থাকা আটক নেতা-কর্মীদেরও মুক্তি দিতে হবে।দলটির
আশঙ্কা, সংলাপে সরকারের সম্মতি ঘোষণার পরপরই সারা দেশে বিএনপি-জামায়াত
একযোগে সহিংসতার তাণ্ডব চালাতে
পারে। দেশজুড়ে
সরকারি-বেসরকারি স্থাপনাগুলোয় হামলা হতে পারে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের বাড়ি এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর ও সম্পদেও আঘাত আসতে পারে। তা ছাড়া আওয়ামী লীগের সিনিয়র
নেতা, মন্ত্রিপরিষদের সদস্য ও শরিক মহাজোটের শীর্ষ নেতারাও এ মুহূর্তে
সহিংসতার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকা বিএনপি
জোটের সঙ্গে
সংলাপ-সমঝোতার চরম বিরোধী। তারা মনে করেন,
সংলাপ-সমঝোতা এ মুহূর্তে সরকারকে দুর্বল করবে। পাঁচ বছর
বজায় রাখা বিঘ্নিত হবে।সূত্রমতে, মহলবিশেষ থেকে সংলাপ-সমঝোতার দাবি আসায়
বেশকিছু পুরনো ইস্যুকে বিশেষ
গুরুত্ব দিচ্ছে
আওয়ামী লীগ। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতবার্ষিকীর দিন ১৫ আগস্ট খালেদা জিয়ার জন্মদিন পালন,
২১ আগস্ট গ্রেনেড
হামলা, বিগত নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রীর সংলাপের আহ্বানে সাড়া না দেওয়া এবং বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে তারেক রহমানের কটূক্তিও সংলাপের পথে বাধা
হিসেবে কাজ করছে। আওয়ামী লীগের
নীতিনির্ধারক
পর্যায়ের এক নেতা বলেন, ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে খালেদা জিয়ার
জীবনবৃত্তান্তে জন্মদিন ছিল সেপ্টেম্বর
মাস। তার পাসপোর্ট
ও মাধ্যমিক পরীক্ষা এসএসসির ফরমে জন্মদিন ১৫ আগস্ট ছিল না। ১৯৯২ সালে জন্ম তারিখ পরিবর্তন করে দলটি। ১৫ আগস্ট করা জন্মদিনের মধ্য দিয়ে নজিরবিহীন খারাপ আচরণ করেছে। এর আগে
প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের
পত্নী হিসেবে কোনো
দিন জন্মদিন পালন করেননি বেগম জিয়া। রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার পর ১৯৯০ সাল পর্যন্ত তাকে জন্মদিন পালন করতে দেখা যায়নি। ২০০১ সালের পর ১৫ আগস্ট শোক দিবসে বিএনপিকে
জন্মদিনের সংস্কৃতি চর্চা করতে দেখা
যাচ্ছে। সংলাপ ও
সমঝোতায় এটিও একটি বড় বাধা।এ প্রসঙ্গে তথ্যমন্ত্রী ও জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, চলমান সংকট নির্বাচন নিয়ে নয়, সংকট বাংলাদেশ বনাম জঙ্গিবাদ নিয়ে। গণতন্ত্র বনাম
আগুনসন্ত্রাস নিয়ে। খালেদা জিয়া
জামায়াতকে নিয়ে
সরাসরি আগুনসন্ত্রাসের নেতৃত্ব দিয়েছেন। আর সে কারণে বর্তমান প্রধান কাজই হলো সন্ত্রাস দমন করে শান্তি ফিরিয়ে আনা। দেশে এ জঙ্গিবাদ দমনের পর রাজনৈতিক শান্তি
রক্ষার্থে আলোচনার বিবেচনা করা যেতেই
পারে। যদিও
নির্বাচন বা সংলাপ কখনো রাজনৈতিক সমাধান নিয়ে আসতে পারেনি। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান,
‘আজকের সংকট একটি
দেশের নয়, একটি পরিবারের। খালেদা জিয়া রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করে তার দুর্নীতিগ্রস্ত
পরিবারকে বাঁচাতে চান। তারা
একাত্তরের
যুদ্ধাপরাধী কিংবা ২১ আগস্টের বোমা হামলার বিচারকাজ বন্ধ করতে চান।’
জামায়াত ছাড়লে
বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় বসবেন কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এখন আর এটি জামায়াত ছাড়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ
নেই। এর মধ্যে আরও অনেক ইস্যু যুক্ত হয়েছে। তা ছাড়া
যারা দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিতে
চায়, দেশের মানুষের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিতে চায়,
আগুন দিয়ে মানুষ হত্যা করে তাদের আর কোনোভাবেই ছাড় দেওয়া
হবে না। তাতে সন্ত্রাসীদের জয় হবে।
আর যদি নির্বাচন
নিয়ে সংলাপের কথা বলেন, তাহলে বলব,
নির্বাচন অবশ্যই
হবে। তবে সংবিধান অনুযায়ী পাঁচ বছর পরই। কেননা, সংবিধানের বাইরে যাওয়ার অধিকার
কারও নেই।’ রাজনৈতিক সংকটের কারণ হিসেবে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী শ ম রেজাউল করিম বলেন,
‘সুস্থ রাজনৈতিক
চর্চা না থাকা, সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখা,
দায়মুক্তির
সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে না পারা,
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারসহ বড় বড় রাজনৈতিক নেতার
বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা নিষ্পত্তি
না হওয়াই অন্যতম
বাধা। সেজন্য একটি মহল অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে চায়। পরিস্থিতি উত্তরণের উপায় হিসেবে তিনি বলেন, সব দলকেই দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন থেকে বেরিয়ে আসতে
হবে। মনে রাখতে হবে, কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। যে কোনো পরিস্থিতিতে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখার পাশাপাশি সব ধরনের বিচারকাজকেও ত্বরান্বিত
করতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
অপরাধ বিভাগের
অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেন, যারা মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে একাত্তরের ঘাতক-দালালদের নিয়ে সরকার গঠন
করে তাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ কেন
সংলাপে বসবে? যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে তা বিএনপির সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণেই হয়েছে। তবে তা সমাধান হয়ে আসছে। এর বিরুদ্ধে আরও জনমত গঠন হলেই সমাধান হয়ে যাবে। তিনি জানান, সন্ত্রাসী গ্রুপের সঙ্গে যে কোনো রাষ্ট্রের সরকারের সংলাপ অপরাধ বিজ্ঞানও সমর্থন করে না।