Science and Technology news - পৃথিবীর আড়ালের এক প্রতিবেশী

সিরিজ নামের এই বামন গ্রহটির নামকরণ করা হয়েছে রোমানদের কৃষি দেবতার নামানুসারে।
  মঙ্গল ছাড়িয়ে বৃহস্পতিতে পৌঁছানোর আগেই চোখে পড়বে আরেকটি গ্রহ। পড়তে ভুল হয়নি! আমাদের এই সৌরজগতের আরেকটি বিস্ময় বস্তু রয়েছে মঙ্গল আর বৃহস্পতির মাঝে। সেই রহস্যময় বস্তু বা বামন গ্রহটির নাম ‘সিরিজ’।
অনেকে হয়তো এই গ্রহটি সম্পর্কে জানেন আবার অনেকেই গ্রহটির কথা ভুলতে বসেছেন। ১৮০১ সালে এই গ্রহটির সন্ধান পেয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা যা প্লুটো আবিষ্কার হওয়ারও ১২৯ বছর আগের ঘটনা। শুরুতে একে গ্রহের মর্যাদা দিয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা কিন্তু পরে একে গ্রহাণু বলে উল্লেখ করেন। সর্বশেষ একে প্লুটোর মতো বামন গ্রহ (ড্রফ প্ল্যানেট) হিসেবে মর্যাদা দিয়েছেন তাঁরা। সিএনএন এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে।
সিরিজ হচ্ছে নাসা ও ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন (এআইইউ) কর্তৃক স্বীকৃত পাঁচটি বামন গ্রহের একটি। সিরিজ ছাড়াও এরিস, প্লুটো, মেকমেক ও হোমিয়া এই চারটি বামন গ্রহের মর্যাদা পেয়েছে।
এত দিন পরে ‘সিরিজ’ নিয়ে এত হইচই কেন তাই ভাবছেন? কারণ হচ্ছে, শিগগিরই এই গ্রহটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানার সুযোগ তৈরি হতে যাচ্ছে। পৃথিবী থেকে এক অতিথি যাচ্ছে সেখানে। যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান নাসার পাঠানো ডন নামের একটি নভোযান আগামী ৬ মার্চ এই গ্রহ পর্যবেক্ষণ শুরু করবে।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার প্যাসাডেনায় অবস্থিত নাসার জেট প্রপালশন ল্যাবরেটরিতে ডন প্রকল্পের ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করছেন রবার্ট মেজ। তিনি এই প্রকল্প সম্পর্কে জানিয়েছেন, ‘সিরিজ এমন একটি গ্রহ যার সম্পর্কে আপনি হয়তো খুব কম শুনেছেন। ’
ডন মিশনের প্রধান প্রকৌশলী ও মিশন পরিচালক মার্ক রেম্যান এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘সিরিজকে আমরা যতই বামন গ্রহ বা ছোট আকারের গ্রহ হিসেবে ডাকি না কেন গ্রহাণু বেল্টের মধ্যে এটিই সবচেয়ে বড়। মঙ্গল ও বৃহস্পতির মধ্যে এটিই যে সবচেয়ে বড় বস্তু শুধু তাই নয়, সূর্য ও প্লুটোর মধ্যেকার সবচেয়ে বড় বস্তু যেখানে এর আগে কোনো নভোযান পৌঁছাতে পারেনি।’
রেম্যান জানিয়েছেন, ‘আমরা দারুণ রোমাঞ্চিত। আমরা এই রোবটিক মিশনটিকে পাঠানোর পর থেকে দীর্ঘ সাত বছর অপেক্ষায় বসে আছি। তিন বিলিয়ন বা ৩০০ কোটি মাইল পথ পাড়ি দিয়ে এই বামন গ্রহে পৌঁছানোর আগে ডন মঙ্গল গ্রহকে অতিক্রম করেছে। এ ছাড়াও ১৪ মাস ধরে প্রোটোপ্লানেট ভেস্তাকে পরিভ্রমণও করেছে ডন। অবশেষে সিরিজে প্রথমবারের মতো অভিযান চালাতে যাচ্ছি আমরা।’
৫২ হাজার মাইল দূর থেকে সম্প্রতি গ্রহটির কিছু ছবি তুলেছে ডন, যাতে এই বামন গ্রহটিতে থাকা গুহা দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। নাসার বিজ্ঞানীরা এই গুহাগুলোকে রহস্যময় গুহা হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
গবেষক রেম্যান জানিয়েছেন, সিরিজের ভূপৃষ্ঠ মোটেও সমতল নয়। এবড়োখেবড়ো এই ভূপৃষ্ঠে রয়েছে অসংখ্য রহস্যময় গুহা।
তাহলে এই এই এবড়োখেবড়ো পাথুরে গ্রহটি নিয়ে এত কৌতূহলের কারণ কী? গবেষক রেম্যান বলেন, ‘গ্রহটি যতই অসমতল হোক এতে টিকে থাকার মতো ব্যবস্থা আছে এবং এটি রহস্যময়। পাথর ও বরফে তৈরি এই গ্রহটির ভূপৃষ্ঠের নিচে পানির প্রবাহ থাকতে পারে। পুকুর, হ্রদ বা সমুদ্রের মতো অঞ্চলও সেখানে থাকতে পারে।’
এক নজরে ‘সিরিজ’
১৮০১ সালে গায়েজেপ্পি পিয়াজ্জি সিরিজ গ্রহটি আবিষ্কার করেন
রোমান মিথলজির কৃষি দেবতার নামানুসারে এর নামকরণ করা হয়েছে
ইংরেজি সিরিয়াল (শস্য) শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে সিরিজ থেকে
গ্রহটির ব্যস হচ্ছে ৫৯০ মাইল (৯৫০ কিলোমিটার)
অ্যাস্টরয়েড বেল্ট এলাকায় আবিষ্কার হওয়া প্রথম বস্তু এটি
কেন সিরিজ নিয়ে গবেষণা?
গবেষক রেম্যান এই বামন গ্রহ নিয়ে গবেষণা প্রসঙ্গে বলেন, ‘এটির গবেষণার মাধ্যমে আমাদের সৌরজগতের সৃষ্টিরহস্য নিয়ে আরও বেশি জানা যাবে। মঙ্গল ও বৃহস্পতির মাঝখানে এর অবস্থান হওয়ায় এটি নিয়ে গবেষণা চালাতে হবে; কারণ আমরা যে বিশ্বে বাস করছি সে সম্পর্কে আমাদের আরও তথ্য জানা দরকার। আমরা এখন মহাজাগতিক জ্ঞান বৃদ্ধি ও মহাবিশ্বকে জানার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমাদের প্রত্যয় ব্যক্ত করার জন্যই এই অভিযান। ’
রেম্যান আরও বলেন, ‘আজ থেকে ২০০ বছর আগে যদি আমাদের সৌরজগতের কথা বলতে হয়, তখন সিরিজকে অবশ্যই আমরা গ্রহ হিসেবেই গ্রহণ করেছিলাম। আমাদের সাম্প্রতিক কয়েকটি প্রজন্ম যেভাবে প্লুটোকে গ্রহ হিসেবে জেনেছে সেভাবেই আমাদের আগের প্রজন্ম সিরিজকেও গ্রহ হিসেবে জেনে এসেছে।’
নাসার বিজ্ঞানীরা বলছেন, সবচেয়ে পরিচিত বামন গ্রহ হচ্ছে প্লুটো। এ বছরের জুলাই মাস থেকে এই গ্রহটিতে নতুন করে পর্যবেক্ষণ শুরু হচ্ছে। প্লুটো ও এর কয়েকটি উপগ্রহ পর্যবেক্ষণের জন্য নিউ হরাইজন মহাকাশযান সেখানে পৌঁছেছে।
মহাকাশে আরও দুটি গ্রহের সম্ভাবনার কথা বলছেন বিজ্ঞানীরাবামন গ্রহ আরও আছে
আমাদের সৌরজগতের পাঁচটি বামন গ্রহের পাশাপাশি নতুন আরও একটি বামন গ্রহ নাসার বিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণের তালিকায় রয়েছে। এর নাম (২০১২ ভিপি ১১৩) যা আমাদের সৌরজগতের সবচেয়ে দূরতম বস্তু। সোলার সিস্টেম এক্সপ্লোরেশন ওয়েবসাইটে নাসার বিজ্ঞানীরা বলছেন, ২০১২ ভিপি ১১৩ বামন গ্রহটিকে তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জোসেফ বাইডেনের নামানুসারে ‘বাইডেন’ নামে ডাকছেন। তবে আইএইউর গবেষকেরা এর নাম ও এটি বামন গ্রহের মর্যাদা পাবে কি না, সে বিষয়ে এখনো আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত নেননি।
ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির গবেষক মাইক ব্রাউন এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘আমাদের সৌরজগতের গ্রহের সংখ্যার হেরফের হতে পারে। এখনো ৩৬০টিরও অধিক বামন গ্রহ আমার পর্যবেক্ষণের তালিকায় রয়েছে। নাসা বলছে, আমাদের পর্যবেক্ষণের বাইরেও অনেক বামন গ্রহ আমাদের এই সৌরজগতের মধ্যেই রয়েছে। ’
রেম্যান বলেন, ‘গ্রহ ও বামন গ্রহের বিষয়টি নিয়ে কথা বলা বিভ্রান্তিকর। কিন্তু বর্তমানে নাসার তালিকা অনুযায়ী গ্রহের সংখ্যা আটটি। সেগুলো হচ্ছে: বুধ, শুক্র, পৃথিবী, মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি, উইরেনাস ও নেপচুন। আগে প্লুটোকে গ্রহের মধ্যে ধরা হলেও পরে ২০০৬ সালে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়নের বিজ্ঞানীরা ‘বামন গ্রহ’ তকমা দিয়ে গ্রহের তালিকা থেকে প্লুটোকে বাদ দেন। এখনো অনেকেই সূর্য থেকে সবচেয়ে দূরের গ্রহ হিসেবে প্লুটোকেই বোঝান। ’
মহাকাশে আরও দুই গ্রহ!
সম্প্রতি স্পেন ও যুক্তরাজ্যের বিজ্ঞানীরা নতুন গ্রহ দুটির অস্তিত্বের সম্ভাবনার কথা জানিয়েছেন। তাঁরা বলছেন, প্লুটোর কক্ষপথের বাইরে এই দুটি গ্রহের অবস্থান হতে পারে। কিন্তু এই গ্রহ দুটি এখনো আবিষ্কার করতে পারেননি বিজ্ঞানীরা।
গবেষকেরা দাবি করেছেন, তাঁদের এই অনুমানের ভিত্তি হচ্ছে প্লুটোর বাইরের কিছু গ্রহাণুর কক্ষপথের অস্বাভাবিক আচরণ। এই গ্রহাণুগুলো এক্সট্রিম ট্রান্স-নেপচুনিয়ান অবজেক্টস বা ইটিএনওস নামে পরিচিত। গবেষকেরা এক ডজনের বেশি ইটিএনওস দীর্ঘদিন ধরে পর্যবেক্ষণ করে দেখেছেন সেগুলো স্বাভাবিক আচরণ করে না। এগুলো এমনভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অবস্থান করে যেন কোনো গ্রহের মতো বিশাল বস্তুর মহাকর্ষীয় শক্তি তাদের আটকে রেখেছে।
এই গ্রহাণুগুলো অস্বাভাবিক কক্ষপথের পরিভ্রমণ দেখে আমাদের মনে হয়েছে অদৃশ্য কোনো শক্তি তাদের কক্ষপথকে আলাদা করে ফেলেছে। এ ধরনের গ্রহের সংখ্যা কত হতে পারে, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে হিসাব করলে দেখা যাবে সৌরজগতে কমপক্ষে আরও দুটি গ্রহ রয়েছে।
-

Latest

Popular Posts

Popular Posts

Popular Posts