Media news - উপন্যাসের মঞ্চভ্রমণ


সে রাতে পূর্ণিমা ছিল নাটকের দৃশ্য
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর জাতীয় নাট্যশালার পরীক্ষণ থিয়েটার হলে ঢুকতেই নীলচে আলো। কিন্তু কেন? আমাদের স্মরণে আসে প্রযোজনাটির নামকরণ, সে রাতে পূর্ণিমা ছিল। আর ঠিক তক্ষুনি সবাই বুঝে উঠতে পারি পরিকল্পিতভাবে ছড়িয়ে রাখা এই জ্যোতির মহিমা। বাংলা ভাষার অসামান্য কথাশিল্পী শহীদুল জহিরের উপন্যাস সে রাতে পূর্ণিমা ছিল। নামকরণের মাঝেই রয়েছে অতীতচারিতার গন্ধ। তাতে আমরা নিশ্চিত হয়ে যাই, এ কাহিনি আগে ঘটে যাওয়া কোনো কিছুর ওপর দাঁড়িয়ে। নবীন নাট্যদল আরশিনগর তাদের আত্মপ্রকাশের প্রযোজনারূপে এই উপন্যাসটিকে অনুবাদ করেছে মঞ্চে। পশ্চিমা শিল্পাদর্শে অথচ দেশজ প্রেক্ষাপটে রচিত উপন্যাসটির আধেয় প্রায় অক্ষুণ্ন রেখে মঞ্চায়ন করেছে দলটি। দুরূহ এই কাজ যাঁর হাত দিয়ে সম্পন্ন হয়েছে, তিনি নির্দেশক রেজা আরিফ। ইতোপূর্বে মাকড়সা, রহু চন্ডালের হাড়, কেরামতমঙ্গল ইত্যাদি প্রযোজনায় তাঁর সামর্থ্যের পরিচয় আমরা পেয়েছি। এই প্রযোজনাতেও তিনি ধরে রেখেছেন তাঁর শিল্পীসত্তার সেই ধারাবাহিকতা।
সে রাতে পূর্ণিমা ছিল উপন্যাসের কাহিনি সুহাসিনী গ্রামের, শ্রমজীবী আকালু ও তার পালিত কন্যা কিংবা স্ত্রী, একজন মফিজউদ্দিন ও চন্দ্রভান, মোল্লা নাসিরউদিন ও দুলালী, আবু বকর সিদ্দিক ও আলেকজানের। এই আখ্যান মফিজউদ্দিনের বন্ধু করিম খাঁর ছেলে আফজাল খাঁর পরিবারের এবং যৌনকর্মী নয়নতারার। এই গল্প কৃষকের, পরম্পরা আর রূপান্তরের কিংবা একটি গ্রামের আবডালে একটি দেশের। হয়তো কেবল প্রেমের কিংবা শেষবিচারে বিভ্রমের। বিভিন্ন উপকাহিনি যুক্ত হয়ে এই উপন্যাসটির আয়তন ও শিল্পসৌকর্য বাড়িয়ে তোলে বহুগুণ। আরিফের দক্ষতা এই যে পুরো উপন্যাসটিকে মঞ্চে মেলে না ধরেও নির্বাচিত দৃশ্য নির্মাণের মধ্য দিয়ে তিনি প্রায় সবটুকু নির্যাস সঞ্চার করতে পেরেছেন দর্শকের মাঝে। উপন্যাস ও নাট্য, এই দুই পৃথক শিল্পমাধ্যমের তুলনা অবান্তর। আমরা বরং প্রযোজনা হিসেবে উপন্যাসটির সাফল্য কিংবা ব্যর্থতার খোঁজ করতে পারি।
প্রযোজনাটিতে ব্যবহার করা হয়েছে প্রায় নিরাভরণ বা অ্যাম্পটি স্পেস। নৌকার গলুইয়ের সাজেশন, ঢেঁকিসদৃশ লিভার আর কিছু দীর্ঘ কাপড়ই বিভিন্ন দৃশ্যে সেটের প্রয়োজন মিটিয়েছে। কিন্তু তাতে কোথাও বিশ্বাসযোগ্যতার ঘাটতি নজরে আসেনি। বর্ণনা ও সংলাপ এবং একই চরিত্রে একাধিক শিল্পী কিংবা একই অভিনেতার একাধিক চরিত্ররূপায়ণের যে কৌশল, তাতে বোঝা যায়, নাটকটির পরিবেশনায় ছিল ঐতিহ্যবাহী বাংলা বর্ণনাত্মক রীতির আধিপত্য। চরিত্র অনুযায়ী বাস্তবতা বিচারে পরিকল্পিত হয়েছে পোশাক। শাহীনুর রহমানের আলো প্রযোজনাটির বিভিন্ন দৃশ্যকে আরও উপভোগ্য করে তুলেছে। সংগীতে দেশীয় বাদ্যের সঙ্গে পাশ্চাত্যের যন্ত্র একই সুরে-তালে বেজেছে। তবে সমবেত কণ্ঠদানের ক্ষেত্রে শিল্পীদের আরও একটু মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন।
২০০২ সালে সেলিম আল দীন উপন্যাসের মঞ্চভ্রমণ অভিধায় সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর কাঁদো নদী কাঁদো উপন্যাসের নির্দেশনা দিয়েছিলেন। পাশ্চাত্য আঙ্গিকে অঙ্ক-দৃশ্য বিভাজনের পথে উপন্যাসের বিলুপ্তি ঘটে বলে মনে করতেন তিনি। এ কারণেই কোনো নাট্যরূপ না দিয়ে কাঁদো নদী কাঁদো উপন্যাসের ভাষা ও কাহিনিকে প্রায় অবিকৃত রেখে হুবহু মঞ্চায়নের চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর সেই অপ্রচলিত ভাবনার উত্তরাধিকার আরশিনগরের প্রথম প্রযোজনা।
থিয়েটার বা নাট্য একটি চলমান ক্রিয়া। সমসময়ে ঘটার পরই মৃত্যু হয় তাঁর। কিন্তু দর্শকের করোটির উঠোনে তাঁর মঞ্চায়ন থামে না কখনো। শিল্পোত্তীর্ণ নান্দনিক প্রযোজনার মাহাত্ম্য এখানেই, দর্শকের হৃদয়ে সেটি বেঁচে থাকে চিরকাল। সে রাতে পূর্ণিমা ছিল সেই পথের যাত্রী।
-

Latest

Popular Posts

Popular Posts

Popular Posts