ভারতের
মনিপুরের নাট্যদল কলাক্ষেত্র–এর নাটক দ্রৌপদী। কথাশিল্পী মহাশ্বেতা দেবীর
গল্প থেকে নেওয়া। ১২ মার্চ সন্ধ্যায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর জাতীয়
নাট্যশালায় আমরা যখন হেইসনাম কানাইলাল নির্দেশিত এ প্রযোজনাটি দেখার
অপেক্ষায়, নাটক শুরুর আগে মঞ্চে দাঁড়িয়ে নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার
বললেন, ‘আপনারা মন্ত্রমুগ্ধের মতো নাটকটি দেখবেন। এখানে চমক আছে।’ তো,
‘চমক’টি কী? না, সেই ভেদ ভাঙব না এখনই। কেবল বলব, প্রযোজনাটি দেখে আমাদের
‘ক্যাথারসিস’ ঘটে যায়, চোখে লেগে থাকে দ্রৌপদী। এমনকি নাটক শেষের পরও
কিছুক্ষণ বিমূঢ় হয়ে বসে থাকি আমরা।
ততক্ষণে প্রবেশ করেছি নাট্যদৃশ্যের গহিনে। মঞ্চ প্রায় ফাঁকা। মাঝ-বরাবর একটি গোলাকার ছোট্ট বাক্স। মঞ্চের পেছন পাশে ‘আপ স্টেজে’ একটি গাছের সাজেশন। নাটকের শুরুতে মঞ্চের দুই পাশ থেকে আলো আসছে ধীরে ধীরে। দেখা গেল, দলনেতাসহ পুলিশ বাহিনীর কয়েকজন সদস্য পাহারারত, তারা এসে দাঁড়াল গোলাকার বাক্সের আশপাশে। এর খানিক বাদেই দেখলাম, আলো পড়ল আপ স্টেজের ওই গাছটির ওপর। এবার মঞ্চে এসেছে প্রধান দুই চরিত্র—দুলনা ও তার স্ত্রী যুবতী বয়সের দ্রৌপদী। পুলিশের গতিবিধির দিকে চোখ রাখছে তারা। অন্যদিকে, পুলিশেরাও খুঁজে ফিরছে তাদের। কেননা, সামন্ত শ্রেণির বিরুদ্ধে তারা লড়াই করছে। তাই পুলিশ সদস্যদের কাছে তাদের পরিচয় ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’।
এই প্রেক্ষাপটে নাট্যকাহিনির দিকে দৃষ্টি ফেরানো যাক: নাটকের পটভূমি ভারতের সাঁওতাল-অধ্যুষিত এক প্রত্যন্ত অঞ্চল। ক্ষমতাসীনদের হাতে অত্যাচারিত হওয়ার একপর্যায়ে প্রথমত ব্যক্তিগত প্রয়োজনে দ্রৌপদী ও তার স্বামী দুলনা লড়াই শুরু করে সামন্তদের বিপক্ষে। কিন্তু লড়াইটি পরে আর ব্যক্তিগত থাকেনি, রূপ নেয় গোটা সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর অস্তিত্বের সংগ্রামে। এর পরম্পরায় এক শিক্ষককে হত্যার দায়ে শুরু হয় তাদের ফেরারি জীবন। দুলনা ধরা পড়ে একসময়। যুবতী দ্রৌপদীর তখন একাকী যুদ্ধ। এরও বেশ পরে দ্রৌপদী যখন বৃদ্ধ, পুলিশের কাছে ধৃত হয় সে। তার ওপর নেমে আসে পুলিশ সদস্যদের নির্মম নিপীড়ন—ধর্ষিত হয় দ্রৌপদী।
পুরো নাটকটি মনিপুরের ভাষায়। ফলে আমাদের কাছে সংলাপের অনেকাংশ অবোধ্য থাকলেও প্রযোজনাটির সবটা বুঝতে এক বিন্দু বেগ পেতে হয় না। রুদ্ধশ্বাসে দৃশ্যের পর দৃশ্য দেখতে থাকি আমরা। বোধ করি সংলাপের চেয়ে এখানে প্রধান হয়ে ওঠে ‘অ্যাকশন’ ও ‘রিঅ্যাকশন’। নিরাভরণতার গুণে কীভাবে একটি প্রযোজনা অনবদ্য হয়ে ওঠে, বোঝা যায় নাটকটি দেখে। তা ছাড়া অভিনয়–কুশিলবদের চলাফেরায় মনিপুরী নৃত্যের চলনভঙ্গি একে দেয় অন্য এক মহিমা।
এক্ষণে দ্রৌপদী কেন চোখে আটকে থাকে, সেই প্রসঙ্গে বলি। দুলনা ধরা পড়ার পর নাটকে দেখা গেল অভিনব এক চমক—শুরু থেকে যুবতী দ্রৌপদীকে দেখে অভ্যস্ত আমাদের চোখ দেখল, মঞ্চে দ্রৌপদীই দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু এবার সে বৃদ্ধ। আমরা ভাবি, যুবতী দ্রৌপদী চরিত্রের এস বেমবেম কি মঞ্চেই মেকআপ নিয়ে এই বৃদ্ধ অবয়বে দাঁড়ালেন? এর আগে একটি ঘটনা ঘটেছে—প্রকাশ্য মঞ্চের আলো-ছায়ার মধ্যে লাল কাপড়াবৃত একজন এসে পেঁচিয়ে ধরল দ্রৌপদীকে। তারপর মঞ্চ ছেড়ে গেল ওই লাল কাপড়াবৃত মানুষ। এর পরক্ষণেই দেখা গেল, বৃদ্ধারূপী দ্রৌপদী। একটু পরে কাটল আমাদের ধন্দও। দেখলাম, এই বৃদ্ধ দ্রৌপদী অন্যজন—এস সাবিত্রী! বুঝতে কারোরই বাকি থাকল না ওই লাল কাপড়ের মাধ্যমেই দ্রৌপদীর এই চমৎকার রূপান্তর। আর নির্দেশনার অভিনবত্বময় এই কৌশলে যেন সৃষ্টি হলো মুহূর্ত—জীবন্ত হয়ে উঠল থিয়েটারও।
তবে চমকের বাকি ছিল আরও—দ্রৌপদী ধরা পড়ার পর পুলিশ সদস্যরা তার ওপর যে শারীরিক নিগ্রহ চালায়, এর শোধ তোলে সে শেষ দৃশ্যে। এ দৃশ্যে দেখতে পাই, নিপীড়নের একপর্যায়ে শরীরে আর কোনো কাপড় রাখতে চাইছে না দ্রৌপদী। রাষ্ট্রযন্ত্র ও সামন্ত শক্তির বিরুদ্ধে এটাই তার প্রতিবাদ। এ সময় তার নগ্ন শরীর দেখে যতই লজ্জা পাচ্ছে পুলিশ, ততই যেন নিজেকে নিরাভরণ করে তুলতে উদ্যত সে। হ্যাঁ, এ দৃশ্যে সত্যি সত্যিই ষাটোর্ধ্ব অভিনেত্রী এস সাবিত্রী শরীরের কাপড় ছুড়ে ফেললেন, প্রায় নগ্ন হলেন; অথচ বিষয়টি নান্দনিকতার সীমা লঙ্ঘন করল না মেটেও। মঞ্চে সে মুহূর্তে নগ্ন দ্রৌপদী লজ্জা দিচ্ছে পুলিশ বাহিনীকে। এদিকে দর্শকসারিতে বসে ‘ক্যাথারসিস’ ঘটছে আমাদের। নগ্ন দ্রৌপদীকে দেখে নয়, কলাক্ষেত্রের এই অনুপম প্রযোজনাটি দেখে কুঁকড়ে মরছি লজ্জায়। কারণ, আমাদের দেশেও তো দ্রৌপদীর মতো অনেক নারী শারীরিক নিগ্রহের শিকার হয়েছেন, এখনো হন।
ততক্ষণে প্রবেশ করেছি নাট্যদৃশ্যের গহিনে। মঞ্চ প্রায় ফাঁকা। মাঝ-বরাবর একটি গোলাকার ছোট্ট বাক্স। মঞ্চের পেছন পাশে ‘আপ স্টেজে’ একটি গাছের সাজেশন। নাটকের শুরুতে মঞ্চের দুই পাশ থেকে আলো আসছে ধীরে ধীরে। দেখা গেল, দলনেতাসহ পুলিশ বাহিনীর কয়েকজন সদস্য পাহারারত, তারা এসে দাঁড়াল গোলাকার বাক্সের আশপাশে। এর খানিক বাদেই দেখলাম, আলো পড়ল আপ স্টেজের ওই গাছটির ওপর। এবার মঞ্চে এসেছে প্রধান দুই চরিত্র—দুলনা ও তার স্ত্রী যুবতী বয়সের দ্রৌপদী। পুলিশের গতিবিধির দিকে চোখ রাখছে তারা। অন্যদিকে, পুলিশেরাও খুঁজে ফিরছে তাদের। কেননা, সামন্ত শ্রেণির বিরুদ্ধে তারা লড়াই করছে। তাই পুলিশ সদস্যদের কাছে তাদের পরিচয় ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’।
এই প্রেক্ষাপটে নাট্যকাহিনির দিকে দৃষ্টি ফেরানো যাক: নাটকের পটভূমি ভারতের সাঁওতাল-অধ্যুষিত এক প্রত্যন্ত অঞ্চল। ক্ষমতাসীনদের হাতে অত্যাচারিত হওয়ার একপর্যায়ে প্রথমত ব্যক্তিগত প্রয়োজনে দ্রৌপদী ও তার স্বামী দুলনা লড়াই শুরু করে সামন্তদের বিপক্ষে। কিন্তু লড়াইটি পরে আর ব্যক্তিগত থাকেনি, রূপ নেয় গোটা সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর অস্তিত্বের সংগ্রামে। এর পরম্পরায় এক শিক্ষককে হত্যার দায়ে শুরু হয় তাদের ফেরারি জীবন। দুলনা ধরা পড়ে একসময়। যুবতী দ্রৌপদীর তখন একাকী যুদ্ধ। এরও বেশ পরে দ্রৌপদী যখন বৃদ্ধ, পুলিশের কাছে ধৃত হয় সে। তার ওপর নেমে আসে পুলিশ সদস্যদের নির্মম নিপীড়ন—ধর্ষিত হয় দ্রৌপদী।
পুরো নাটকটি মনিপুরের ভাষায়। ফলে আমাদের কাছে সংলাপের অনেকাংশ অবোধ্য থাকলেও প্রযোজনাটির সবটা বুঝতে এক বিন্দু বেগ পেতে হয় না। রুদ্ধশ্বাসে দৃশ্যের পর দৃশ্য দেখতে থাকি আমরা। বোধ করি সংলাপের চেয়ে এখানে প্রধান হয়ে ওঠে ‘অ্যাকশন’ ও ‘রিঅ্যাকশন’। নিরাভরণতার গুণে কীভাবে একটি প্রযোজনা অনবদ্য হয়ে ওঠে, বোঝা যায় নাটকটি দেখে। তা ছাড়া অভিনয়–কুশিলবদের চলাফেরায় মনিপুরী নৃত্যের চলনভঙ্গি একে দেয় অন্য এক মহিমা।
এক্ষণে দ্রৌপদী কেন চোখে আটকে থাকে, সেই প্রসঙ্গে বলি। দুলনা ধরা পড়ার পর নাটকে দেখা গেল অভিনব এক চমক—শুরু থেকে যুবতী দ্রৌপদীকে দেখে অভ্যস্ত আমাদের চোখ দেখল, মঞ্চে দ্রৌপদীই দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু এবার সে বৃদ্ধ। আমরা ভাবি, যুবতী দ্রৌপদী চরিত্রের এস বেমবেম কি মঞ্চেই মেকআপ নিয়ে এই বৃদ্ধ অবয়বে দাঁড়ালেন? এর আগে একটি ঘটনা ঘটেছে—প্রকাশ্য মঞ্চের আলো-ছায়ার মধ্যে লাল কাপড়াবৃত একজন এসে পেঁচিয়ে ধরল দ্রৌপদীকে। তারপর মঞ্চ ছেড়ে গেল ওই লাল কাপড়াবৃত মানুষ। এর পরক্ষণেই দেখা গেল, বৃদ্ধারূপী দ্রৌপদী। একটু পরে কাটল আমাদের ধন্দও। দেখলাম, এই বৃদ্ধ দ্রৌপদী অন্যজন—এস সাবিত্রী! বুঝতে কারোরই বাকি থাকল না ওই লাল কাপড়ের মাধ্যমেই দ্রৌপদীর এই চমৎকার রূপান্তর। আর নির্দেশনার অভিনবত্বময় এই কৌশলে যেন সৃষ্টি হলো মুহূর্ত—জীবন্ত হয়ে উঠল থিয়েটারও।
তবে চমকের বাকি ছিল আরও—দ্রৌপদী ধরা পড়ার পর পুলিশ সদস্যরা তার ওপর যে শারীরিক নিগ্রহ চালায়, এর শোধ তোলে সে শেষ দৃশ্যে। এ দৃশ্যে দেখতে পাই, নিপীড়নের একপর্যায়ে শরীরে আর কোনো কাপড় রাখতে চাইছে না দ্রৌপদী। রাষ্ট্রযন্ত্র ও সামন্ত শক্তির বিরুদ্ধে এটাই তার প্রতিবাদ। এ সময় তার নগ্ন শরীর দেখে যতই লজ্জা পাচ্ছে পুলিশ, ততই যেন নিজেকে নিরাভরণ করে তুলতে উদ্যত সে। হ্যাঁ, এ দৃশ্যে সত্যি সত্যিই ষাটোর্ধ্ব অভিনেত্রী এস সাবিত্রী শরীরের কাপড় ছুড়ে ফেললেন, প্রায় নগ্ন হলেন; অথচ বিষয়টি নান্দনিকতার সীমা লঙ্ঘন করল না মেটেও। মঞ্চে সে মুহূর্তে নগ্ন দ্রৌপদী লজ্জা দিচ্ছে পুলিশ বাহিনীকে। এদিকে দর্শকসারিতে বসে ‘ক্যাথারসিস’ ঘটছে আমাদের। নগ্ন দ্রৌপদীকে দেখে নয়, কলাক্ষেত্রের এই অনুপম প্রযোজনাটি দেখে কুঁকড়ে মরছি লজ্জায়। কারণ, আমাদের দেশেও তো দ্রৌপদীর মতো অনেক নারী শারীরিক নিগ্রহের শিকার হয়েছেন, এখনো হন।