একটি
কথা আজকাল প্রায়ই শোনা যায়, তরুণদের কণ্ঠে দেশাত্মবোধক গান সেভাবে শোনা
যায় না। কথাটি যদি বিনাবাক্যে কবুল করে নিই, তবে এর দায় অনেকাংশে আমাদের
ওপরেও বর্তায়। আবার এও মনে হয়, আমাদের সব আন্দোলনে, প্রতিবাদে ও উদ্দীপনায়
তরুণেরাই তো কণ্ঠে বারবার ধারণ করেছেন দেশপ্রেমের গান। তাহলে এ কথাটি
আসছে কেন?
খানিক পরে খোঁজার চেষ্টা করি প্রশ্নটির উত্তর। এখন বরং বলি সেই স্বর্ণসময়ের কথা। তখন আমরা তরুণ। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে এক হয়েছি ভিন্ন এক যুদ্ধে, কণ্ঠে দেশপ্রেমের গান তুলে নিয়ে একটি ফুলকে বাঁচানোর প্রত্যয়ে। হ্যাঁ, আমাদের ভেতর সে সময় ছিল অন্য রকম এক শক্তি। সেই শক্তির বলে বলীয়ান হয়েই তো একের পর এক গান তৈরি করেছি আমরা।
স্মৃতিপটে ফিরে আসে কলকাতার টালিগঞ্জের সেই দোতলা বাড়ি, যেখানে ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দপ্তর। ছিল মাত্র একটি ঘর। এই একটি ঘরেই চলত স্বাধীন বাংলা বেতারের সমুদয় কার্যক্রম—একদিকে খবর অন্যদিকে নানা ধরনের অনুষ্ঠান।
গানের জন্য আমাদের সম্বল ছিল একটি হারমোনিয়াম ও তবলা এবং একটি ভাঙা টেপরেকর্ডার। এই সামান্য দ্রব্যাদি দিয়েই আমরা গান গেয়েছি। মনে পড়ে, একেকটি গানের জন্য খুব সামান্য সময় পেতাম—১০ থেকে ১৫ মিনিটে গান লিখে ও সুর দিয়ে ৩০ মিনিটের মধ্যেই রেকর্ড করা হতো গানটি। ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি’, ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’, ‘রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি বাংলাদেশের নাম’ গানগুলো তো সৃষ্টি হয়েছে এই প্রক্রিয়ায়।
যুদ্ধদিনের কথা স্মরণ হতেই কত কিছু মনে পড়ছে এখন—তখন আমাদের খাবার-দাবারের ঠিকঠিকানা ছিল না কোনো; এমনও হয়েছে একটি শিঙাড়া খেয়ে কাটিয়ে দিয়েছি দিন। আর আমাদের এই অনাহারী দিনগুলোকেই তো মহীয়ান করেছে অজস্র দেশপ্রেমের গান।
দুঃখের বিষয় হলো, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, বিশেষত ১৯৭৫ সালের পর পরিকল্পিতভাবে নষ্ট করে ফেলা হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনেক টেপ, যার মধ্যে ছিল আমাদের অসংখ্য গানও। পরে আশির দশকের শেষ দিকে মেজর জেনারেল আমীন আহম্মেদ চৌধুরী (তখন ব্রিগেডিয়ার) যখন মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান ছিলেন, দুটো লংপ্লেতে স্বাধীন বাংলা বেতারের ২৪টি গান রেকর্ড করিয়েছিলেন তিনি। তিনি ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা। এখন স্বাধীন বাংলা বেতারের যেসব গান শোনা যায়, তা আমীন সাহেবের উদ্যোগেরই ফসল। যদিও এই কাজের জন্য চড়া মূল্য গুনতে হয়েছিল তাঁকে—মুক্তিযোদ্ধা ট্রাস্টের সভাপতির দায়িত্ব থেকে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
এর কিছু সময় পর একুশে টেলিভিশনের গোড়ার দিকে একুশে টিভির উদ্যোগে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী ও নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের সমন্বয়ে স্বাধীন বাংলা বেতারের ১০/১৫টি গান করা হয়। তখন উদ্যোগটি প্রশংসিত হয়েছিল। বিশেষত নতুন প্রজন্মের কণ্ঠে দেশাত্মবোধক গানগুলো দারুণভাবে উদ্দীপ্ত করে সবাইকে।
এ ঘটনা নতুন উপলব্ধি দিল আমাকে—মনে হলো, না, দেশবন্ধনার গান, মুক্তিযুদ্ধের গান তরুণেরা প্রাণ দিয়েই গায়, গাইতে পারে। কেবল বন্ধ দরজা ও অর্গলগুলো সরিয়ে দিতে হবে তাঁদের সামনে থেকে।
তরুণদের দিয়ে দেশপ্রেমের গান গাওয়ানোর আরও একটি সুযোগ আসে ২০০০ সালের প্রথমার্ধে, ‘ক্লোজআপ ওয়ান তোমাকেই খুঁজছে বাংলাদেশ’-এর মাধ্যমে। প্রতিযোগিতামূলক এই গানের অনুষ্ঠানের একজন বিচারক ছিলাম আমি। সেই সূত্রে অনুষ্ঠানটির আয়োজক প্রতিষ্ঠান ইউনিলিভারকে প্রস্তাব করি, প্রতিযোগীদের দিয়ে দেশপ্রেমের গানগুলো গাওয়াতে চাই আমি। সানন্দে মিলল সম্মতি। ‘ক্লোজআপ’-এর সেই সময়ের তারকারা গাইল দেশপ্রেমের, স্বাধীন বাংলা বেতারের গানগুলো। গানগুলো গাইতে গাইতে তখন ওরা বলত, ‘মনে হচ্ছে আমরা যেন এখন যুদ্ধের মধ্যে আছি।’
২০০০ সালের প্রথমার্ধে এ সময়ের তরুণ শিল্পীরা কেবল গানের মাধ্যমে যুদ্ধের স্পর্শ পাচ্ছে—ব্যাপারটি কিন্তু উল্লেখ করার মতো। মনে আছে, গলায় একেকটি গান তুলছে ওরা, আর আমি তাদেরকে বলছি সেই গানের জন্মকাহিনি। এভাবে এই শতকের প্রথম প্রহরে সে সময় আমাদের মধ্যে আবার ফিরে এসেছিল ১৯৭১ সালের আবহ। তারপর এই গানগুলো নিয়ে তৈরি করা হয় চারটি সিডি; কিন্তু আফসোসের বিষয় হলো, সিডিগুলো বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাত করা হয়নি।
এর মধ্যেই লেখার এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে বলার চেষ্টা করেছি আমাদের তারুণ্যকে কীভাবে অনুপ্রাণিত করে দেশপ্রেমের গান, দেশবন্দনার গান গলায় তুলে কতটা আবেগাপ্লুত হয়ে ওঠে তরুণ সমাজ। হ্যাঁ, এর কিছুটা বোঝা গেছে হয়তো। সবশেষে বলি, স্বাধীনতার গান, দেশমাতৃকার গান এখনো গাইতে চায় তরুণেরা। তবে তাদের সামনে গানগুলো তো উন্মুক্ত করতে হবে; অনেক তো হলো, বন্ধ দরজাগুলো এবার খুলে দাও।
খানিক পরে খোঁজার চেষ্টা করি প্রশ্নটির উত্তর। এখন বরং বলি সেই স্বর্ণসময়ের কথা। তখন আমরা তরুণ। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে এক হয়েছি ভিন্ন এক যুদ্ধে, কণ্ঠে দেশপ্রেমের গান তুলে নিয়ে একটি ফুলকে বাঁচানোর প্রত্যয়ে। হ্যাঁ, আমাদের ভেতর সে সময় ছিল অন্য রকম এক শক্তি। সেই শক্তির বলে বলীয়ান হয়েই তো একের পর এক গান তৈরি করেছি আমরা।
স্মৃতিপটে ফিরে আসে কলকাতার টালিগঞ্জের সেই দোতলা বাড়ি, যেখানে ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দপ্তর। ছিল মাত্র একটি ঘর। এই একটি ঘরেই চলত স্বাধীন বাংলা বেতারের সমুদয় কার্যক্রম—একদিকে খবর অন্যদিকে নানা ধরনের অনুষ্ঠান।
গানের জন্য আমাদের সম্বল ছিল একটি হারমোনিয়াম ও তবলা এবং একটি ভাঙা টেপরেকর্ডার। এই সামান্য দ্রব্যাদি দিয়েই আমরা গান গেয়েছি। মনে পড়ে, একেকটি গানের জন্য খুব সামান্য সময় পেতাম—১০ থেকে ১৫ মিনিটে গান লিখে ও সুর দিয়ে ৩০ মিনিটের মধ্যেই রেকর্ড করা হতো গানটি। ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি’, ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’, ‘রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি বাংলাদেশের নাম’ গানগুলো তো সৃষ্টি হয়েছে এই প্রক্রিয়ায়।
যুদ্ধদিনের কথা স্মরণ হতেই কত কিছু মনে পড়ছে এখন—তখন আমাদের খাবার-দাবারের ঠিকঠিকানা ছিল না কোনো; এমনও হয়েছে একটি শিঙাড়া খেয়ে কাটিয়ে দিয়েছি দিন। আর আমাদের এই অনাহারী দিনগুলোকেই তো মহীয়ান করেছে অজস্র দেশপ্রেমের গান।
দুঃখের বিষয় হলো, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, বিশেষত ১৯৭৫ সালের পর পরিকল্পিতভাবে নষ্ট করে ফেলা হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনেক টেপ, যার মধ্যে ছিল আমাদের অসংখ্য গানও। পরে আশির দশকের শেষ দিকে মেজর জেনারেল আমীন আহম্মেদ চৌধুরী (তখন ব্রিগেডিয়ার) যখন মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান ছিলেন, দুটো লংপ্লেতে স্বাধীন বাংলা বেতারের ২৪টি গান রেকর্ড করিয়েছিলেন তিনি। তিনি ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা। এখন স্বাধীন বাংলা বেতারের যেসব গান শোনা যায়, তা আমীন সাহেবের উদ্যোগেরই ফসল। যদিও এই কাজের জন্য চড়া মূল্য গুনতে হয়েছিল তাঁকে—মুক্তিযোদ্ধা ট্রাস্টের সভাপতির দায়িত্ব থেকে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
এর কিছু সময় পর একুশে টেলিভিশনের গোড়ার দিকে একুশে টিভির উদ্যোগে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী ও নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের সমন্বয়ে স্বাধীন বাংলা বেতারের ১০/১৫টি গান করা হয়। তখন উদ্যোগটি প্রশংসিত হয়েছিল। বিশেষত নতুন প্রজন্মের কণ্ঠে দেশাত্মবোধক গানগুলো দারুণভাবে উদ্দীপ্ত করে সবাইকে।
এ ঘটনা নতুন উপলব্ধি দিল আমাকে—মনে হলো, না, দেশবন্ধনার গান, মুক্তিযুদ্ধের গান তরুণেরা প্রাণ দিয়েই গায়, গাইতে পারে। কেবল বন্ধ দরজা ও অর্গলগুলো সরিয়ে দিতে হবে তাঁদের সামনে থেকে।
তরুণদের দিয়ে দেশপ্রেমের গান গাওয়ানোর আরও একটি সুযোগ আসে ২০০০ সালের প্রথমার্ধে, ‘ক্লোজআপ ওয়ান তোমাকেই খুঁজছে বাংলাদেশ’-এর মাধ্যমে। প্রতিযোগিতামূলক এই গানের অনুষ্ঠানের একজন বিচারক ছিলাম আমি। সেই সূত্রে অনুষ্ঠানটির আয়োজক প্রতিষ্ঠান ইউনিলিভারকে প্রস্তাব করি, প্রতিযোগীদের দিয়ে দেশপ্রেমের গানগুলো গাওয়াতে চাই আমি। সানন্দে মিলল সম্মতি। ‘ক্লোজআপ’-এর সেই সময়ের তারকারা গাইল দেশপ্রেমের, স্বাধীন বাংলা বেতারের গানগুলো। গানগুলো গাইতে গাইতে তখন ওরা বলত, ‘মনে হচ্ছে আমরা যেন এখন যুদ্ধের মধ্যে আছি।’
২০০০ সালের প্রথমার্ধে এ সময়ের তরুণ শিল্পীরা কেবল গানের মাধ্যমে যুদ্ধের স্পর্শ পাচ্ছে—ব্যাপারটি কিন্তু উল্লেখ করার মতো। মনে আছে, গলায় একেকটি গান তুলছে ওরা, আর আমি তাদেরকে বলছি সেই গানের জন্মকাহিনি। এভাবে এই শতকের প্রথম প্রহরে সে সময় আমাদের মধ্যে আবার ফিরে এসেছিল ১৯৭১ সালের আবহ। তারপর এই গানগুলো নিয়ে তৈরি করা হয় চারটি সিডি; কিন্তু আফসোসের বিষয় হলো, সিডিগুলো বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাত করা হয়নি।
এর মধ্যেই লেখার এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে বলার চেষ্টা করেছি আমাদের তারুণ্যকে কীভাবে অনুপ্রাণিত করে দেশপ্রেমের গান, দেশবন্দনার গান গলায় তুলে কতটা আবেগাপ্লুত হয়ে ওঠে তরুণ সমাজ। হ্যাঁ, এর কিছুটা বোঝা গেছে হয়তো। সবশেষে বলি, স্বাধীনতার গান, দেশমাতৃকার গান এখনো গাইতে চায় তরুণেরা। তবে তাদের সামনে গানগুলো তো উন্মুক্ত করতে হবে; অনেক তো হলো, বন্ধ দরজাগুলো এবার খুলে দাও।