ডায়রিয়া বা উদরাময়ে আক্রান্ত তিন বছরের শিশু জুবায়েরকে নিয়ে গতকাল
বৃহস্পতিবার দুপুরে ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ডাইরিয়াল ডিজিজ রিসার্চ
সেন্টার, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি)-এ এসেছিলেন অটোরিক্সাচালক কামাল হোসেন ও
তার স্ত্রী শারমীন বেগম। উত্কণ্ঠা নিয়ে ছুটে আসা এই দম্পতি জরুরি বিভাগে
কর্তব্যরত চিকিত্সক ডা. তারেক ইমতিয়াজের কাছে গিয়ে জানালেন, দু’দিন ধরে
জুবায়ের শুধু পানির মতো টলটলে মলত্যাগ করছে, খাবারও খেতে পারছে না, মুখ
দিয়ে কিছু দেয়ামাত্র বমি করে ফেলে দিচ্ছে। খুবই দুর্বল হয়ে পড়া জুবায়েরকে
হাসপাতালে ভর্তি করে দ্রুত স্যালাইন দেয়ার ব্যবস্থা করলেন চিকিত্সক তারেক
ইমতিয়াজ।
জুবায়েরকে প্রাথমিক চিকিত্সা দেয়ার পর ডা. তারেক
ইমতিয়াজ ‘ইত্তেফাক’কে জানান, এটা আইসিডিডিআর,বি’র নিত্যদিনের দৃশ্য। তবে গত
কয়েকদিনের প্রচণ্ড রোদ-গরমে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা বেড়ে প্রায়
দ্বিগুণ। শিশুদের অধিক হারে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার কারণ হিসাবে তারেক
জানালেন, এখানে যেসব শিশু আসে তাদের সিংহভাগই মায়ের বুকের দুধ বঞ্চিত।
জন্মের পর টানা ছয় মাস পর্যন্ত যারা সঠিকভাবে মায়ের দুধ পায়নি বা খেতে
পারেনি-তারাই বেশিরভাগ পানিশূন্যতায় আক্রান্ত হচ্ছে। মায়ের বুকের দুধের
পরিবর্তে যারা বাজারের গুঁড়ো দুধ খাচ্ছে, তাদের দেহে অনেক সময় ফিডার থেকেও
রোগের জীবাণু সংক্রমিত হয়। কারণ ফিডারের ভেতরে ও ছিদ্রযুক্ত মুখে আঙ্গুল
যেতে না পারায় তা ভালোভাবে পরিষ্কার করা সম্ভব হয় না। ফলে ফিডার থেকেও
শিশুর দেহে নানা রোগের জীবাণু সংক্রমিত হয়। ডা. তারেক আরও জানান, বুকের দুধ
পান করলে মায়ের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শিশুর দেহেও সঞ্চারিত হয়।
‘এক্সক্লুসিভ ব্রেস্টফিডিং’ বা জন্ম থেকে ৬ মাস পর্যন্ত যেসব শিশু শুধু
মায়ের দুধ পান করে, অন্যকোন খাবার এমনকি এক ফোঁটা পানিও পান করে না-তাদের
শুধু শিশু বয়সেই নয়, পরিণত বয়সেও রোগ-বালাই কম হয়।
রাজধানীর
বারিধারায় ‘গুলশান মা ও শিশু হাসপাতাল’-এর প্রবীণ শিশু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এ
আর রহমান ‘ইত্তেফাকে’র সঙ্গে আলাপকালে জানান, যেসব শিশু বুকের দুধ পান করে
না, তার খাবারে গাভীর দুধ বা ল্যাকটোজসমৃদ্ধ উপাদান কমিয়ে আনা দরকার। অনেক
সময় শিশুর ল্যাকটোজ অসহনশীলতা থাকে ও বার বার ডায়রিয়া হয়।
শুধু
আইসিডিডিআর,বি-তেই নয়, গত কয়েকদিনে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল,
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল (বিএসএমএমইউ) ও হলি
ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডসহ কয়েকটি বেসরকারি
ক্লিনিকের শিশু বিভাগে গিয়ে কর্তব্যরত চিকিত্সকদের সঙ্গে কথা বলে জানা
গেছে, বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে যেসব শিশু হাসপাতালে আসছে তাদের
অধিকাংশেরই কেস স্টাডিতে দেখা যাচ্ছে, মূল সমস্যা হলো-মায়ের দুধ না খাওয়ায়
তাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম।
মায়ের দুধের পক্ষে মত দিয়ে
চিকিত্সকরা বলছেন, মায়ের দুধে শিশুর জন্য অত্যন্ত জরুরি এবং উপকারী ১১০টি
উপাদান আছে। শিশুর রোগ প্রতিরোধ, মেধা বিকাশ এবং সুষমভাবে বেড়ে উঠতে মায়ের
দুধের বিকল্প নেই। অন্যদিকে বাজারে মায়ের দুধের বিকল্প হিসাবে যেসব খাদ্য
বিক্রি হচ্ছে, তা শিশুর জন্য ক্ষতিকর।
শিশুদের বুকের দুধ খাওয়ার
বিষয়ে গণসচেতনতা সৃষ্টির জন্য সরকারের কার্যক্রম সম্পর্কে স্বাস্থ্য
মন্ত্রণালয়ের সচিব সৈয়দ মন্জরুল ইসলাম জানান, শিশুকে মায়ের দুধ খাওয়ানোর
জন্য গণসচেতনতা তৈরিতে রোড শো, শোভাযাত্রাসহ বিভিন্ন আয়োজন করতে হবে। যেসব
জায়গায় মায়ের দুধের গুরুত্বের বিষয়টি পৌঁছায়নি, সেখানে পৌঁছাতে হবে। এতে
করে বাংলাদেশে মায়ের দুধ খাওয়ানোর যে হার, তার আরও বাড়বে। একইসঙ্গে
স্বাস্থ্যবান শিশু পেতে মায়েদের পরিপূর্ণ পুষ্টির ওপর জোর দিয়ে সচিব জানান,
দেশে ৪৫ ভাগ শিশু মারা যায় পুষ্টির অভাবে।
বিশিষ্ট শিশু
বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এমকিউকে তালুকদার শিশুর ছয় মাস বয়স পর্যন্ত বুকের দুধই
যথেষ্ট, এর বাইরে পানিরও দরকার নেই বলে জানান। শিশুর ছয় মাসের পর থেকে দুই
বছর পর্যন্ত মায়ের দুধের পাশাপাশি বাড়ির হাঁড়ির তৈরি সম্পূরক খাবারও
খাওয়াতে হবে। এতে করে সেই সময় এবং এরপর জীবনব্যাপীই তার ভালো থাকার
সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে শিশুকে শালদুধ খাওয়ানোর ওপরও
জোর দেন তিনি। বাংলাদেশ ব্রেস্টফিডিং ফাউন্ডেশনের (বিবিএফ) সচিব
শিশুবিশেষজ্ঞ সুফিয়া খাতুন জানান, স্বাস্থ্যকর্মীকে মায়েদের বিকল্প
শিশুখাদ্যের অপকারিতা সম্পর্কে জানাতে হবে। মায়েদের পুষ্টি এবং শিশুকে
বুকের দুধ খাওয়ার লক্ষ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির বিষয়ে ইনস্টিটিউট অব পাবলিক
হেল্থ নিউট্রিশন-এর পরিচালক ড. মো. আলমগীর আহমেদ ‘ইত্তেফাক’কে জানান, মৌলিক
পুষ্টি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে প্রতিষ্ঠানটি মায়েদেরসহ সকল নারীর কাছে
পুষ্টিবার্তা পাঠাচ্ছে। গণমাধ্যম ও স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে পাঠানো এই
বার্তায় শিশুদের ছয় মাস পর্যন্ত শুধু বুকের দুধ খাওয়ানোর জন্য গণসচেতনতা
বাড়ানো হচ্ছে।
এমডিজি’র পরবর্তী বৈশ্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যগুলো কী
হওয়া উচিত, তা নিয়ে বাংলাদেশে কাজ করছেন বিশ্বের প্রথম সারির থিঙ্কট্যাংক
কোপেনহেগেন কনসেনশাসের প্রেসিডেন্ট ড. বিয়ন লোমবোর্গ। গত ৯ মার্চ ঢাকায়
ব্র্যাক সেন্টারে ‘ইত্তেফাক’র এই প্রতিবেদকসহ বাংলাদেশের কয়েকজন সাংবাদিকের
সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় তিনি বলেন, ‘এমডিজির সাফল্যের পর জাতিসংঘ ২০১৬ থেকে
২০৩০ সাল মেয়াদি উন্নয়নের যে নতুন লক্ষ্য নির্ধারণের পরিকল্পনা করছে সেখানে
কোনটিতে খরচ কত, কোনগুলো বেশি ফলদায়ক-সেই বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে।
কস্ট-বেনিফিট পর্যালোচনায় দেখা গেছে-পুষ্টির পেছনে সবচেয়ে কম বিনিয়োগ করে
সবচেয়ে বেশি প্রাপ্তি সম্ভব। সেক্ষেত্রে যদি মায়েদের সঠিক পুষ্টি দেয়া যায়
এবং শিশুদের বুকের দুধ দিতে পারলে কার্যত একটি স্বাস্থ্যবান জাতি গঠন
সম্ভব, যার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে মূলত জাতীয় অর্থনীতিতে। একই অনুষ্ঠানে
‘গ্লোবাল এলায়েন্স ফর ইম্প্রুভড্ নিউট্রিশন (গেইন)-এর মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট
সাপ্লিমেন্ট বিভাগের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা ও ব্যবস্থাপক ড. রুবাবা খন্দকার
বলেন, স্বাস্থ্যবান প্রজন্ম থেকে অর্থনৈতিক প্রাপ্তি অনেক। যশোর জেলার
অভয়নগর উপজেলায় চালানো আইসিডিডিআর,বি’র সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে,
সেখানে শিশুদের ‘এক্সক্লুসিভ ব্রেস্টফিডিং’ (জন্মের পর থেকে ৬ মাস বুকের
দুধ ছাড়া এক ফোঁটা পানিও না খাওয়ানো)-এর হার মাত্র ১৫ শতাংশ। অবশ্য ঢাকা
আরবান এলাকায় এর হার ৭০ শতাংশের কাছাকাছি।