বামে আকাশ ছোঁয়া পাহাড় আর ডানে সাগরের গর্জন। মাঝে পিচঢালা পথ। সবমিলিয়ে এক অন্য রকম পরিবেশ। নিসর্গে নিমগ্ন হতে চাইলে আসুন এখানে
রাজনৈতিক অস্থিরতা, এরমাঝে হঠাত্ তিন দিনের ছুটির ফাঁদে ব্যবসা
প্রতিষ্ঠান। অর্থাত্ রুটি-রুজির পথ বন্ধ। কিন্তু তাতে কি, ভ্রমণপিয়াসী
‘দে-ছুট’-এর বন্ধুরা তো এই মোক্ষম সুযোগ হাতছাড়া করতে পারে না। দ্রুত
কক্সবাজারের টিকিট কাটা হলো। সময় বিকাল ৪টা ৪৫ মিনিট, বাবার রক্ত চক্ষু
উপেক্ষা করে বের হয়ে গেলাম সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ডের উদ্দেশে। বিশেষ কারণে
রাত ১১টার গাড়ি ৭টায় ছাড়বে। প্রচণ্ড জ্যাম। রিকশা ছেড়ে পায়ে হাঁটতে শুরু
করি। হাঁটতে হাঁটতে সঠিক সময়ে পৌঁছে যাই। গাড়ি ছাড়ল। কিছুক্ষণ যেতেই
যাত্রাবাড়ি মোড়ে জ্যামে আটকে পড়তে হয়। সময়টা কাজে লাগাই। একজন দুজন করে
সহযাত্রীদের সাথে পরিচিতি হতে শুরু করি। বাস গাইডের মাধ্যমে জানতে পারি,
একচল্লিশ জন যাত্রীর মধ্যে ঊনচল্লিশ জনই যাবে কক্সবাজারে। তাদের বেশির ভাগই
পুরাতন ঢাকার হওয়ায় সখ্যতা গড়তে খুব একটা সময় লাগে না। এরই মধ্যে
উচ্ছ্বাসিত এক যাত্রী ‘চলো না ঘুরে আসি অজানাতে’ গানটি গাইতে শুরু করে, তার
সাথে আরও কয়েকজন কণ্ঠ মেলায়। গান শেষে যখন তাকে দে-ছুটের পক্ষ থেকে মজা
করার জন্য দশ টাকার একটি নোট দেওয়া হয়, তখন সে অনুপ্রাণিত হয়ে আবারও গান
ধরে। ভবের চর গিয়ে গাড়ি ফুল ব্রেক। তাই এবারের গান, ‘গাড়ি চলে না, চলে
না...’
গাড়ি ধীর গতিতে চলছে, শ্রোতাদের উদ্দেশে জিজ্ঞাসা করলাম,
গুরু আযম খান কি বেঁচে আছেন না মারা গেছেন। সবাই বলল মারা গেছেন। আপনারা
ভুল বললেন, সৃজনশীলরা কখনো মরে না, বেঁচে থাকে মানুষেরই মাঝে। সবার মাঝে
পিনপতন নীরবতা এলো। আজ আযম খান নেই কিন্তু আছে তার গান, রয়েছে তার সুর।
আপনারা এখন তারই গান শুনবেন দে-ছুটের পক্ষ থেকে। সবাই হাততালি দিয়ে স্বাগত
জানায়। প্রথমেই শুরু করি ‘ওরে সালেকা ওরে মালেকা...’। যে কজন এতক্ষণ ভাব
নিয়েছিল, তারাও এখন সুর মেলাতে শুরু করে। দে-ছুটের সফলতা এখানেই। গাইতে
গাইতে ভোকাল পেরেশান, এবার তার শেষ গান ‘এই গান শেষ গান/আর বুঝি গাওয়া হবে
না/এই রাত শেষ রাত/আর বুঝি ভোর হবে না।’ গাড়ির গতি এখন পুরোদমে। রাতের
খাবারের জন্য মিয়ার বাজার গিয়ে বিরতি দিল। খেয়েদেয়ে গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে
সবাই ঘুমিয়ে পড়ি। সকালের এক মুঠো রোদ চোখে পড়ায় ঘুম ভাঙে। জেগে দেখি
চকরিয়া। ড্রাইভার বিরতি দিতে চাইল রেস্টুরেন্টে। কিন্তু যাত্রীদের বারণে
সোজা কক্সবাজার এসে থামল। কলাতলি মোড় আসতেই যাত্রীরা যার যার সুবিধামতো
নেমে পড়ে। আমরাও একসময় নেমে পড়ি। স্মৃতির আঙ্গিনায় স্মরণীয় হয়ে থাকল,
পাবলিক বাসে মঞ্চ বানানোর গল্প। ভেবেছিলাম, বিকেলের আগে আর হোটেল লবি থেকে
বের হবো না কিন্তু বারান্দায় যেতেই সাগরের হাতছানি। চটজলদি থ্রি কোয়ার্টার
প্যান্ট পরে সোজা লাবনী বিচে। বিশাল ঢেউ আর বালিয়াড়ির শামুক, ঝিনুকে সময়
কাটিয়ে ভাটা শুরুর পর আমরা হোটেলে ফিরি।
সন্ধ্যার পর কলাতলী
বিচে গিয়ে দীর্ঘক্ষণ সাগর পানে চেয়ে থাকি, আর মনে মনে ভাবি, মানুষের হূদয়
যদি এমন বিশাল হতো, তাহলে জগত্সংসারে এত হানাহানি হয়তো হতো না। চাঁদের আলো
সম্বল করে বিচের দক্ষিণ দিকে হাঁটি।
পরের দিন যেতে হবে মূল
প্রোগ্রাম বড় ডেইল। তাই রাতেই কক্সবাজারের বাসিন্দা নুরুল আযিমকে দিয়ে
মাইক্রো ভাড়া করি। সকালে নির্ধারিত সময়ে গাড়ি এলো, রওনা হই মেরিন ড্রাইভের
পথ ধরে। কলাতলী বিচ থেকে দু কি.মি. পথ যেতেই পর্যটকদের জটলা দেখতে পাই।
গাড়ি থামিয়ে জানতে পারি, এটি দরিয়ানগর পর্যটন কেন্দ্র। জনপ্রতি বিশ টাকা
করে টিকেট কেটে প্রবেশ করলাম। ভিতরে ঢুকতেই চোখ ছানাবড়া। প্রাকৃতিক ও
কৃত্রিমতার সমন্বয়ে অদ্ভুত এক সৌন্দর্য গড়ে তুলেছেন উদ্যমী কয়েকজন যুবক।
কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে পুরো পার্কটি ঘুরিয়ে দেখালেন। সেখানে রয়েছে ওয়াচ
টাওয়ার, প্যারামাউন্ট ঝরনা, প্রাকৃতিক জলাধার এবং বেশ রহস্যময় আওলিয়া গুহা।
যারা একটু অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়, তারা কটেজে থেকে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে
বেশি রাতে গুহায় প্রবেশ করে এক ভিন্ন রকম অনুভূতি লাভের মজা পাবেন।
এবার বড় ডেইলের পথে। নতুন কোনো জায়গার নাম শুনলে মন উত্তাল হয়ে উঠে। গাড়ি
চলছে, টেকনাফের শাপলাপুর বাজারে জহুরের নামাজ ও লাঞ্চের জন্য বিরতি নিই।
সাগরের মাছ দিয়ে খুব মজা করে খেলাম। রান্নাও হয়েছে বেশ চমত্কার। আবারও গাড়ি
স্টার্ট। ছুটছে গাড়ি ডানে সাগরের উত্তাল ঢেউ আর বামে পাহাড়কে পাশ কাটিয়ে।
প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট গর্জন বাগান যেন মাথা উঁচু করে পর্যটকদের নিরাপত্তা
দিতে প্রহরী হয়ে আছে এখানে। গাড়ি এসে থামল বড় ডেইল ডাক ছাড়া ব্রিজে।
কক্সবাজার থেকে ৪৮ কি.মি. দূরে টেকনাফ উপজেলার অন্তর্গত এই জায়গাটি। বড়
ডেইল মানে বিশাল বালিয়াড়ি। নামকরণের সাথে জায়গাটির সুন্দর মিল আছে। বিচের
সামনের ঝাউতলায় চেয়ার পাতা ও দোলনা ঝুলানো ছিল।
বড় ডেইলের
প্রাকৃতিক পরিবেশ এত এত অপার্থিব সুন্দর যে, সরেজমিনে না গেলে বোঝা সম্ভব
না। আকাশ ছোঁয়া পাহাড়, প্রাকৃতিক বন, জংলী ক্যাকটাস, উত্তাল ঢেউ, ঝাউ গাছের
ঝিরিঝিরি বাতাস—কোনো পর্যটক বিমোহিত না হয়ে পারবে না। আমি তো ঝাউগাছের
সাথে বাঁধা দোলনায় দোল খেতে খেতে হারিয়ে গিয়েছিলাম প্রকৃতির মাঝে। এতটাই
আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েছিলাম যে, সেখানেই দিনের আলো পুরোটা কাটিয়ে দিই।
ভ্রমণপিয়াসী বন্ধুরা আপনারা যারা শুধু লাবনী পয়েন্ট বা কলাতলী বিচ কিংবা
বার্মিজ মার্কেটের কক্সবাজারকে চেনেন, তারা এবার প্রস্তুতি নিন বড় ডেইলের
পথে যেতে। পাবেন প্রকৃতির মাঝে মনের সুখ খুঁজে পাওয়ার অভিজ্ঞতা। সেইসাথে
পাবেন সাগরের জলে লুটোপুটি খাওয়ার সুযোগ। পূজা ও ঈদের লম্বা ছুটিতে
বন্ধুদের পাশাপাশি পুরো পরিবার নিয়ে নৈসর্গিক জেলা কক্সবাজারের স্বপ্নময়
সৌন্দর্যের সাথে পরিচিত হয়ে আসতে পারেন।
কী কী দেখবেন
কক্সাজার বিচ, বৌদ্ধ মন্দির, দরিয়া নগরের আদম গুহা ও ঝরনা, হিমছড়ি, ইনানী
বিচ, পাটুয়ার টেকের কানারাজার গুহা, গর্জন বাগান এবং বড় ডেইলের
ঝাউবাগান।
কীভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে কক্সবাজার
যেতে বিভিন্ন পরিবহনের সাধারণ থেকে বিলাসবহুল বাস সার্ভিস আছে। ভাড়া ৬০০
থেকে ১৪০০ টাকা পর্যন্ত। কলাতলী ডলফিন মোড় থেকে যেতে হবে সিএনজি বা জিপে,
তবে মাইক্রো নিলে মজাই পাবেন আাালাদা। মাইক্রো ভাড়া দরদামভেদে ২৫০০ থেকে
৩০০০ টাকা।