একুশ আমাদের গর্ব। একুশ আমাদের অহংকার। যা আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের
মর্যাদা পেয়েছে। এ অর্জন পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশকে যেমন গৌরবময়
ভূমিকায় প্রতিষ্ঠিত করেছে, তেমনিভাবে পৃথিবীর অন্যান্য ভাষার সাথে
বাংলাভাষাও তার নিজস্ব মহিমায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। মহান একুশকে সামনে রেখে
আমাদের দেশীয় ফ্যাশন হাউসগুলো প্রতিবারের মতো এবারও সেজেছে নানা
বৈচিত্র্যময় পোশাকে। পোশাকে বর্ণমালার গল্প নিয়ে এবারের মূল ফিচার। লিখেছেন
নওশীন শর্মিলী
একুশে ফেব্রুয়ারি
বাঙালি জাতির এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। আর আজ এই ফেব্রুয়ারি ভাষার মাস হিসেবে
সমগ্র বিশ্বের কাছে পরিচিত। এই মাসে মাতৃভাষার চেতনায় ও শ্রদ্ধায় অবনত হয়
সারা বিশ্বের মানুষ। লক্ষণীয় বিষয় হলো—এই ফেব্রুয়ারি মাসে কৃষ্টি ও
ঐতিহ্যের বিকাশের লক্ষ্যে দেশীয় ফ্যাশন হাউস ও প্রতিষ্ঠানসমূহ একুশের
বিষয়বস্তুনির্ভর চেতনা জাগানিয়া পোশাকআশাক ও ফ্যাশন সামগ্রী তৈরি করে থাকে।
যা বিগত বছরগুলোতে জনসাধারণের পৃষ্ঠপোষকতায় ও মিডিয়ার সহযোগিতায় আরও
সমৃদ্ধ হয়েছে। সাদা ও কালো রঙের সমন্বয়ে তৈরি পোশাক ও অন্যান্য সামগ্রী
সংগ্রহের ক্ষেত্রে ক্রেতাদের থাকে একটি বেদনার্ত ইতিহাস স্মরণের চেষ্টা।
তাই বিয়োগ-ব্যথার প্রতীক কালো রঙই মূলত সবক্ষেত্রে প্রাধান্য পেয়ে থাকে।
পোশাকে ও অন্যান্য সামগ্রীতে বর্ণমালা, শহীদ মিনার, একুশের পঙিক্তমালা,
শহীদদের প্রতিকৃতিও থাকে বিভিন্ন আঙ্গিকে। এ ছাড়া থাকে বাঙালির চেতনার
প্রতিনিধিত্বকারী নানা বিষয়; যা আমাদের শহীদদের আত্মত্যাগের স্মৃতিকে
ফুটিয়ে তোলে। ভাষার প্রতি বাঙালির রয়েছে শেকড়ের টান। এই ভালোবাসা যেমন থাকে
বাঙালির লেখায়, রেখায় ও দৈনন্দিন জীবনযাপনে; তেমনি থাকে ফ্যাশনের ভুবনেও
সশ্রদ্ধ প্রকাশের চেষ্টা। ভাষার মাস যখন বছর ঘুরে আবেগতাড়িত বাঙালির
প্রাঙ্গণে এসে ছায়া ফেলে, ঠিক তারই সঙ্গে এসে হাজির হয় ঋতুরাজ বসন্ত।
একদিকে শোকার্ত অতীতের ধূসর ছায়া, অন্যদিকে বসন্তের রঙিন আবেশ। শোক যেন
সাহস হয়ে সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখায় এ সময়। একুশের আবেগমথিত প্রহরের
করুণ সুরেলা আবহ ‘রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারির’ প্রাণাবেগকে করে তোলে
বেদনাপ্লুত। আর তাই শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, চিত্রকলা, ফ্যাশন—আমাদের
প্রতিটি শৈল্পিক ভাবনায় একুশে ফেব্রুয়ারির দারুণ প্রভাব খুঁজে পাওয়া যায়।
যে প্রভাবের স্পর্শে আলোকিত হয়ে উঠেছে বাংলা কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটকসহ
নানা অঙ্গন। সর্বোপরি প্রতিবছর বাংলা একাডেমী আয়োজন করে মাসব্যাপী বইমেলার।
যে বইমেলা আজ প্রাণের মেলারূপে প্রতিটি বাঙালির মনে জায়গা করে নিয়েছে।
পাশাপাশি একুশের চেতনাকে ধারণ করে সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও চলে নানা আয়োজন।
একুশের চেতনার ধারা শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির বুকে যে প্রাণপ্রবাহ সৃষ্টি
করেছে, সাম্প্রতিককালে তারই ছোঁয়া লেগেছে দেশের ফ্যাশন ট্রেন্ডেও। বাঙালির
দৈনন্দিন জীবনে পোশাক একটি অপরিহার্য অনুষঙ্গ। যে অনুষঙ্গের গহীনে এখন চলছে
দেশীয় মোটিফে করা আধুনিকবোধের প্রকাশ। বিভিন্ন উত্সবের পাশাপাশি নগরবাসীরা
একুশের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে পোশাকের প্রতিও তাদের অকুণ্ঠ সমর্থন প্রদানের
মধ্যদিয়ে শহীদ দিবসের মর্মগাথাকে প্রতিবছরের ফেব্রুয়ারিতে শরীরে জড়িয়ে নেন
গভীর ভালোবাসায়। দেশীয় ফেব্রিকে তৈরি একুশের পোশাক বিভিন্ন ফ্যাশন হাউসের
আউটলেট থেকে সংগ্রহের উদ্যোগ শুরু হয় ফেব্রুয়ারির গোঁড়া থেকে। রাজধানীর
শতাধিক ফ্যাশন হাউস নাগরিক জীবনের পরম এই অনুষঙ্গকে অত্যন্ত নান্দনিকরূপে
উপস্থাপনের লক্ষ্যে গ্রহণ করে বিপুল আয়োজন। এই আয়োজনে থাকে পাঞ্জাবি,
শার্ট, ফতুয়া, শাড়ি, থ্রিপিস, টি-শার্ট, পট, শোপিস, টিপট, মগসহ নানা
সামগ্রী। বর্তমানের বয়ানে একুশের চেতনা ফুটিয়ে তোলার এক শক্তিশালী মাধ্যম
হয়ে উঠেছে নানা গল্পের পটভূমি হয়ে থাকা টি-শার্ট। টি-শার্টের ছোট্ট এক
চিলতে জমিনে যে কত আবেগ আর অনুভূতি এক হয়ে মিশে যেতে পারে, তা যেন সময়ের
প্রতিটি পরতে পরতে একটু একটু করে উন্মোচিত হচ্ছে আমাদের সামনে। আর তাই
একুশের চেতনাকে ধারণ করে থাকা টি-শার্টগুলোতে যেমন দেখা মেলে চিরাচরিত
বর্ণমালার সুনিপুণ কোনো বিন্যাস, তেমনি এই সীমিত ক্যানভাসেই অপরিসীম আবেদন
নিয়ে উঠে আসে দেশের প্রতি ভালোবাসার নানা গল্প। একটা সময় ছিল, যখন ফাল্গুন
আর একুশের আয়োজনে মেয়েদের প্রথম পছন্দ ছিল শাড়ি। শাড়ির প্রতি সেই পক্ষপাত
হয়তো এই সময়ের মেয়েদের মাঝেও কমবেশি বিদ্যমান। সাদা-কালো কিংবা নীলের
পটভূমিতে একুশের বর্ণমালাকে ধারণ করা মেয়েদের শাড়িতে সুতির প্রাধান্যই
বেশি। এ ছাড়া বলতে হয় মেয়েদের মাথা আর গলায় গাঁদা ফুলের সাজের কথা। একদিকে
একুশের শহীদ বেদিতে গাঁদা কিংবা গোলাপের শ্রদ্ধার্ঘ, আর অন্যদিকে একুশের
চেতনায় সামিল হওয়া কোনো তরুণীর মাথায় শোভা পাওয়া গাঁদার মালা যেন একুশের
ছন্দটাকেই নিয়ে আসে সকলের মাঝে। আবার মাথায় বাংলাদেশের পতাকার রঙের কোনো
ফেট্টি বা হাতে লাল-সবুজের কোনো ব্রেসলেটও আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয় ভিন্ন এক
অনুভূতির সাথে। সেই সাথে ছোট-বড় সকলের গালে রংতুলির ছোঁয়ায় জন্ম নেওয়া
বর্ণমালা আর শহীদ মিনারও যেন সবাইকে মনে করিয়ে দেয়—আজ একুশে ফেব্রুয়ারি। এই
দিনটি শোককে শক্তিতে পরিণত করে ভাষার জন্য ভালোবাসা প্রকাশের দিন।