মোগল
সম্রাট মহামতি আকবর ৫ নভেম্বর, ১৫৫৬ সাল থেকে হিসাব ধরে বৈশাখকে প্রথম মাস
ধরে নতুন ফসলি সন বা অব্দ প্রচলন করেন। তখন থেকেই বাংলা নববর্ষ আবর্ত বা
ঋতুধর্মী উত্সব হিসাবে পালিত হতে শুরু করে
গাছে গাছে নতুন সজীব পাতা। রোদে ঝিকমিক করছে। বাতাসে আন্দোলিত পাকা ধানের
শীষে। হঠাত্ বৃষ্টিতে ভিজে যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে বৃক্ষরাজি, শ্যামল
ফসলের মাঠ। বাংলার প্রকৃতিতে এমন দৃশ্য জানান দিচ্ছে বসন্তের দিন পেরিয়ে
গ্রীষ্ম সমাগত। নতুন বছর বাঙালির দ্বারে। আর বাংলা নববর্ষ বরণ ও উদযাপনে
অবিচ্ছেদ্য অংশ মেলা। বছরের শেষদিনকে বিদায় ও নতুন বছরকে বরণ করে নিতে
চৈত্র সংক্রান্তি ও বৈশাখী মেলায় বাংলা ও বাঙালি মেতে ওঠে অনাবিল আনন্দে। এ
মেলা বাঙালির আনন্দঘন লোকায়ত সংস্কৃতির ধারক, আবহমান বাংলা ও বাংলাদেশের
প্রতিমূর্তি। সময়ের প্রবাহে মোগল প্রবর্তিত বাংলা নববর্ষের উদযাপন-আয়োজনে
এসেছে পরিবর্তন। পরিবর্তন এসেছে চৈত্রসংক্রান্তি ও বৈশাখী মেলায়ও।
ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায়, বৈদিক যুগে বাংলা সনের প্রথম মাস ছিল অগ্রহায়ণ।
মোগল সম্রাট আকবর ১৫৮৪ সালের ১০ কিংবা ১১ মার্চ ফসলি সন হিসেবে বৈশাখ
মাসকে বাংলাবর্ষের প্রথম ধরে বাংলা বর্ষপঞ্জি প্রবর্তন করেন। তবে
বর্ষপঞ্জিটি কার্যকর হয় তার সিংহাসনে বসার সময় ৫ নভেম্বর ১৫৫৬ সালের হিসাব
ধরে। তখন থেকেই বাংলা নববর্ষ আর্তব উত্সব বা ঋতুধর্মী উত্সব হিসেবে পালিত
হতো। বাংলার কৃষকরা চৈত্রমাসের শেষদিন পর্যন্ত জমিদার, তালুকদার এবং
অন্যান্য ভূ-স্বামীর খাজনা পরিশোধ করত। পরদিন নববর্ষে ভূ-স্বামীরা তাদের
মিষ্টিমুখ করাতেন। এ উপলক্ষে তখন মেলা এবং অন্যান্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করো
হত। তবে তখন মেলা ছিল জমিদারিকেন্দ্রিক। প্রাসাদ নগরের অভ্যন্তরে,
কেন্দ্রীয় বাজারে, বড় ময়দানে কিংবা নদীর পাড়ে তাবু ও তাবুহীন মেলা বসত। এতে
বিভিন্ন ধরনের মিষ্টান্ন ও ফল, নিত্যদিনের ব্যবহারের পণ্য ছাড়াও দেশীয়
অস্ত্র পাওয়া যেত। ধীরে ধীরে এটি সামাজিক পরিবেশে উত্সবমুখর হয়ে উঠে।
সামাজিক উত্সবমুখর পরিবেশে বৈশাখ মাসে বাংলায় খাজনা আদায় শুরু করেন নবাব
মুর্শিদকুলী খান। জমিদারি আমলে পহেলা বৈশাখের প্রধান আয়োজন ছিল খাজনা আদায়
উপলক্ষে ‘রাজপুণ্যাহ’ ও ব্যবসায়ীদের ‘হালখাতা’। জমিদারি প্রথা বিলোপের পর
‘রাজপুণ্যাহ’ লুপ্ত হয়ে যায়। এ রাজপুণ্যাহ কেন্দ্রিক মেলায় ফসলি কারবারিদের
যে আনাগোনা ছিল, তাও কমে যায়।
পহেলা বৈশাখ উদযাপনের আগে
চৈত্রের শেষ দিন অর্থাত্ চৈত্র সংক্রান্তির মেলার ঐতিহ্যও দীর্ঘদিনের।
শুরুতে চৈত্রসংক্রান্তিতে প্রজারা জমিদার ও তালুকদারদের খাজনা পরিশোধের দিন
হিসেবেই পালন করত। পরে ধীরে ধীরে এ উপলক্ষেও মেলা গড়ে উঠে। শহুরে বাঙালির
চেয়ে গ্রাম-মফস্বলের বাঙালিরাই এতে বেশি মেতে উঠেন। তাই গ্রামীণ জনপদে এখনও
পহেলা বৈশাখের মেলার চেয়ে চৈত্র সংক্রান্তির মেলা বেশি জনপ্রিয় ও বিস্তৃত।
বিসিকের তথ্যমতে বাংলাদেশে সবেচেয়ে বেশি মেলা হয় চৈত্র সংক্রান্তি
উপলক্ষে। তবে আগে চৈত্র সংক্রান্তিতে চড়কপূজার প্রচলন থাকলেও এখন তেমন দেখা
যায় না।
বর্তমানে দেশের অধিকাংশ গ্রাম ও মফস্বল শহরে
চৈত্রসংক্রান্তি ও বৈশাখী মেলা একাকার হয়ে গেছে। মূলত চৈত্রসংক্রান্তির
মেলাগুলো দুই থেতে সাত দিন ধরে আয়োজনের ফলে এমনটা হয়েছে। সীতাকুণ্ডসহ দেশের
কয়েকটি স্থানে এখনও চৈত্রসংক্রান্তির মেলায় চড়কপূজার প্রচলন রয়েছে। তবে
অধিকাংশ মেলাই এখন পণ্যসমাহারের স্থানে পরিণত হয়েছে। কৃষিজাত পণ্য, কুটির
শিল্পজাত পণ্য, মিষ্টান্ন ও মাটির তৈরি নানা ধরনের পণ্যের বিপুল সমাহার ঘটে
মেলার দোকানগুলোতে। বাজারের খোলা জায়গায়, কয়েকটি গ্রামের মিলনস্থল বড়
ময়দান কিংবা বিদ্যায়তনের মাঠে এ মেলা বসে। দোকানগুলোতে কৃৃষকদের
নিত্যব্যবহার্য লাঙল ও জোয়ালের দেখা মিলত দুই দশক আগেও। এখন গ্রামীণ এ
মেলাগুলোতে দা, বটি, কোদাল, হাতুড়ি, কাঁচি, ছুরি, পিতল-কাঁসা, বাঁশ ও বেতের
জিনিসপত্রের দেখা মিলে এখনও। মেলায় শুধু কেনাকাটা নয় বিনোদনও মিলে।
সার্কাস, নাগরদোলা, পুতুল নাচের দল, ম্যাজিক শো মেলাকে করে তুলে আরো বর্ণিল
ও আনন্দময়।
চৈত্র সংক্রান্তির পরই বাঙালির দরজায় নতুন বছরের
আগমন। উত্সবপ্রিয় বাঙালির নতুন বছরকে বরণ করে নেয়ারও প্রধান অনুষঙ্গ হয়ে
দাঁড়ায় মেলা, বৈশাখী মেলা। শুরুতে নববর্ষের প্রথমদিনে জমিদাররা প্রজাদের
মিষ্টি খাওয়াতেন। এ উত্সব উপলক্ষে যে মেলা বসত তাতে কৃষি ও কৃষিজাত পণ্যই
বেশি থাকত। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে প্রথম মহাযুদ্ধ চলার সময়ও বাংলায় বৈশাখী মেলা
আয়োজনের তথ্য পাওয়া যায়। তখন ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে কীর্তন ও পূজার
ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৩৮ সালেও এ ধরনের পূজার তথ্য পাওয়া যায়। ১৯৬৭ সালের আগে
বিপুল আয়োজনে পহেলা বৈশাখ পালনের রীতি তেমন জনপ্রিয় হয়নি। নববর্ষ উদযাপনের
রীতি যত জনপ্রিয় হয়েছে মেলার সংখ্যাও বেড়েছে। ’৭০ থেকে ৯০’র দশক পর্যন্ত
মেলায় গ্রামীণ আবহ ছিল পুরোদমে। নববর্ষকে উত্সবমুখর করে তোলে বৈশাখী মেলা।
স্থানীয় কৃষিজাত দ্রব্য, কারুপণ্য, লোকশিল্পজাত পণ্য, কুটির শিল্পজাত
সামগ্রী, হস্তশিল্পজাত ও মৃিশল্পজাত সামগ্রীতে মেলা থাকে পূর্ণ।
শিশু-কিশোরদের খেলনা, মহিলাদের সাজ-সজ্জার সামগ্রী এবং চিড়া, মুড়ি, মড়কি,
খৈ, বাতাসার মত বিভিন্ন লোকজ খাদ্যদ্রব্য ও মিষ্টান্নের সমারোহ মেলাকে
বিশেষ বৈশিষ্ট্যে মন্ডিত করে। মেলায় বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের লোকগায়ক ও
লোকনর্তকদের উপস্থিতি থাকে। তাঁরা যাত্রা, পালাগান, কবিগান, জারিগান,
গম্ভীরা গান, গাজীর গান, আলকাপ গানসহ বিভিন্ন ধরনের লোকসঙ্গীত,
বাউল-মারফতি-মুর্শিদী-ভাটিয়ালিসহ আঞ্চলিক গান পরিবেশন করেন। লাইলী-মজনু,
ইউসুফ-জুলেখা, রাধা-কৃষ্ণ’র মত আখ্যান নিয়ে যাত্রা-নাটক প্রদর্শিত হয়।
পুতুলনাচ, নাগরদোলা, সার্কাস, বায়োস্কোপ থাকে মেলার বিশেষ আকর্ষণ।
প্রায় শত বছর আগের মেহেরপুরের এক গ্রামীণ মেলা সম্পর্কে দীনেন্দ্র কুমার
রায় তার ‘পল্লীচিত্র’ বইয়ে লিখেছেন, ‘দোকান-পশারীও কম আসে নাই। দক্ষিণে
কৃষ্ণনগর ও পশ্চিমে বহরমপুর, নদীয়া ও মুর্শিদাবাদের এই প্রধান নগরদ্বয়
হইতেও বিস্তর দোকান আসিয়াছে। দোকানদারেরা সারি সারি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র
অস্থায়ী চালা তুলিয়া তাহার মধ্যে দোকান খুলিয়া বসিয়াছে। দুইদিকে দোকান,
মধ্যে সংকীর্ণ পথ। এক এক রকম জিনিসের দোকান এক এক দিকে। কোথাও কাপড়ের
দোকান, কোথাও বাসনের, কোথাও নানাবিধ মনোহারী দ্রব্যের দোকান।’ তিনি উল্লেখ
করেছেন, ‘এতরকম সুন্দর পিতল-কাঁসার বাসন আমদানি হইয়াছে যে, দেখিলে চক্ষু
জুড়ায়...। কৃষ্ণনগর হইতে মাটির পুতুলের দোকান আসিয়াছে; নানারকম সুন্দর
সুন্দর পুতুল...। জুতার দোকানে চাষীর ভয়ঙ্কর ভিড়; পেটে ভাত না থাক, পায়ে
জুতা চাই...। ... কাপড়ের দোকান অনেক দেখিলাম। চাষারা সেখানে বোম্বাই কাপড়
চাহিতেছে কিন্তু দোকানদারেরা বোম্বাই বলিয়া অসঙ্কোচে বিলাতি চালাইতেছে...!’
পহেলা বৈশাখে কোথাও কোথাও প্রচলিত পণ্য সমারোহেরও বাইরেও ভিন্ন ধরনের মেলা
বসত। যেমন: দিনাজপুরের নেকমর্দনের মেলায় একসময় হাতি-ঘোড়া, উট-মেষ-গরু
আমদানি হত। ঝালকাঠির কাজীর রাঙার মেলায় পাওয়া যেত নানা ধরনের নৌকা।
কিশোরগঞ্জের রথমেলায় উঠত নানা জাতের পাখি। সাতক্ষীরার গুড় পুকুরের মেলায়
আসত আম-জাম-লিচু কাঁঠালসহ নানা ফলদ বৃক্ষের কলমের চারা।
আবহমান
বাংলার সেই চিরায়ত বৈশিষ্ট্য নিয়ে এখন হয়ত বৈশাখী মেলা বসে না। তবে বাঙালি
ঐতিহ্যের স্মারক-স্মৃতি বহন করে এ মেলাগুলোও। বর্তমানে ক্ষুদ্র ও
কুটিরশিল্প সংস্থা, পর্যটন করপোরেশন, বাংলা একাডেমী এবং লোক ও কারুশিল্প
ফাউন্ডেশনের পরিকল্পিত আয়োজনে বৈশাখী মেলা নতুন মাত্রা পেয়েছে। রাজধানী
ঢাকা ছাড়াও বিপুল আয়োজনে বৈশাখী মেলা বসে নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ,
মানিকগঞ্জ, সাভার, রংপুরের পায়রাবন্দ, গাইবান্ধার ফুলছড়িঘাট এলাকা, বগুড়ার
মহাস্থানগড়, কুমিল্লার লাঙ্গলকোট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, মহেশপুর, খুলনার
সাতগাছী, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, সিলেটের জাফলং, মণিপুর, বরিশালের
ব্যাসকাঠি-বাটনাতলা, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, টুঙ্গিপাড়ায়। এছাড়ার শুভাঢ্যার
বৈশাখী মেলা, টঙ্গীর স্নানকাটা মেলা, মিরপুর দিগাঁও মেলা, সোলারটেক মেলা,
শ্যামসিদ্ধি মেলা, ভাগ্যকুল মেলা, কুকটিয়া মেলা, রাজনগর মেলা, দিনাজপুরের
ফুলতলী, ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈল, রাজশাহীর শিবতলীর বৈশাখী মেলায়
বিপুলসংখ্যক মানুষের সমাগম ঘটে।
প্রায় শতবছরের ঐতিহ্য লালন করে
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের জয়পুর গ্রামে এখনও বউমেলা নামে এক ব্যতিক্রমী
বৈশাখী মেলা বসে। প্রায় পাঁচ দিনব্যাপী চলে মেলাটি। প্রাচীন একটি বটবৃক্ষের
নিচে এই মেলা বসে, যদিও সনাতন ধর্মাবলম্বীরা সিদ্ধেশ্বরী দেবীর পূজা
হিসেবে এখানে সমবেত হয়। এখানে এখনও পাঁঠাবলির রেওয়াজ রয়েছে। সোনারগাঁর
পেরাব গ্রামের পাশে ঘোড়ামেলা নামে আরেকটি মেলাও বহু বছর ধরে প্রচলিত রয়েছে।
আধুনিককালে শহরের মেলায় চিরায়ত গ্রামীণ ঐতিহ্যের সেই শক্তিশালী অবস্থান আর
নেই। যাত্রা বা নাটক প্রদর্শনীর স্থান দখল করেছে চলচ্চিত্র প্রদর্শনী।
কৃষি ও কৃষিজাত পণ্যের স্থলে বেশি শোভা পায় শিল্পপণ্য। মাটির তৈরি খেলনার
চেয়ে প্লাস্টিক ও ইলেক্ট্রনিক খেলনাই বেশি জনপ্রিয়। আগে খোলা ময়দানে মেলার
বেশি আয়োজন হলেও এখন বাজার-মার্কেট কেন্দ্রিক আয়োজনই বেশি। রাজধানীতে ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, রমনা, বনানী, গুলশানে কিংবা চট্টগ্রামের ডিসি
হিলে এখন নববর্ষ উপলক্ষে আয়োজিত মেলায় আধুনিকতার ছোঁয়া বিপুল। তবে মেলাগুলো
থেকে আবহমান ঐতিহ্যের স্মারক-স্মৃতি হারিয়ে যায়নি বলেই মনে করেন
লোক-সংস্কৃতি গবেষকরা। এ প্রসঙ্গে বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক এবং
লোকসাহিত্যিক-গবেষক ড. শামসুজ্জামান খান বলেন, বাংলা নববর্ষ উদযাপন ও মেলা
পরস্পরের সাথে ওতপ্রোতভাবে সংশ্লিষ্ট। মেলা ছাড়া চৈত্র সংক্রান্তি বা পহেলা
বৈশাখ উদযাপন চিন্তাও করা যায় না। বাঙালি ফুরসত পেলেই যে মিলনের-বন্ধনের
টানে ছুটে বেড়ায় তারও প্রতীক মেলা। তিনি বলেন, আবহমান বাংলার ঐতিহ্যের পুরো
লালন হয়তো এখনকার মেলায় সেভাবে হয় না। তবে অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতির চেতনা
এখনও সমানই আছে। তাই নগর কিংবা গ্রামে এখনও মেলা আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। এর
আবেদন শেষ হবার নয়– এর আঙ্গিক ও প্রকৃতি ভিন্ন হতে পারে।