উপার্জনক্ষম মানুষটি নেই। উনুন জ্বলছে না চার মাস ধরে । খেয়ে না খেয়ে চলছে
মা-মেয়ের সংসার। টাকার অভাবে একমাত্র মেয়ের পড়ালেখা বন্ধ হয়ে গেছে। নতুন
সমস্যা হচ্ছে থাকার জায়গা নিয়ে। অথচ চার মাস আগেও পরিবারটির এমন দুরবস্থা
ছিল না। সুখেই কাটছিল। হরতাল-অবরোধের মধ্যে ট্রাক চালাতে গিয়ে দুর্বৃত্তদের
ছোঁড়া ইটের আঘাতে পরিবারের উপার্জনক্ষম মানুষটির মৃত্যুর পর সংসারে অভাবের
উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে। সেই তাপের আগুনে পুড়ছে একমাত্র মেয়ের ভবিষ্যত্।
উপার্জনক্ষম মানুষটির নাম ইমাদুর রহমান (৩৬)। পেশায় ট্রাকচালক। নাটোরের
গুরুদাসপুর উপজেলার নাজিরপুর ইউনিয়নের জুমাইনগর (মামুদপুর) গ্রামে তার
বাড়ি। স্ত্রী আসমা বেগম (২৪) ও একমাত্র মেয়ে তানিয়াকে (৬) নিয়ে ছিল তার
সংসার। নিজের কোন জায়গা-জমি ছিল না। ইমাদুরের মায়ের জায়গায় দোচালা টিনের ঘর
তুলে সেখানেই বসবাস করতো পরিবারটি। ইমাদুরের আয়েই চলতো তিন সদস্যের
পরিবারটি। গতকাল দুপুরে ইমাদুরের বাসায় গিয়ে দেখা গেল, টিনের চালায় টিনের
বেড়া দিয়ে তৈরি দুই কক্ষের ঘরটিতে তালা ঝুলছে। উঠানে আবর্জনার স্তূপ। একটি
পাতিহাঁস বিচরণ করছে। টালির ছাপরায় রান্নার চুলা থাকলেও দীর্ঘদিন রান্না
হয়নি– তা দেখেই বুঝা গেল। প্রতিবেশী বেলাল হোসেন জানালেন, মেয়েসহ পাশের
বাড়িতে কাজে গেছে ইমাদারের স্ত্রী আসমা। পরে বেলালকে অনুরোধ করে ডেকে আনা
হয়।
ইমাদারের স্ত্রী জানালেন, তার বাবার বাড়ি সিরাজগঞ্জের
চৌহালী উপজেলার সৈলজান গ্রামে। ১২ বছর আগে ট্রাক চালক ইমাদারকে বিয়ে করেন।
শাশুড়ির জায়গায় ঘর তুলে বসবাস করছেন। এত বছর ট্রাকচালক স্বামীর আয়ে ভালোই
চলেছে সংসার। মানুষটি মারা যাওয়ার পর এখন সংসার চলছে না। বাধ্য হয়ে এবাড়ি
ওবাড়ি কাজ করে পেট চালাই। আর পেট চালাতে গিয়ে মেয়ের পড়ালেখা বন্ধ হয়ে গেছে।
নতুন সমস্যা হচ্ছে, যে জায়গাটিতে ঘর তুলে বসবাস করছেন সেই জায়গাটি ছেড়ে
দিতে বলছে অন্য শরিকরা। এ কারণে নিরুপায় হয়ে পড়ছেন তিনি। আসমা কান্নাজড়িত
কণ্ঠে জানান, তার স্বামী মারা গেলেও সরকারি-বেসরকারি কোন সাহায্য-সহায়তা
পাননি। যে মালিকের ট্রাক চালিয়েছেন তিনিও কোন খবর রাখেননি। ঢাকা থেকে
স্বামীর লাশ আনতে হয়েছে চাঁদা তুলে। নদীভাঙ্গা এলাকায় বাবার বাড়ি, তাদের
অভাব বেশি তাই কষ্ট করে স্বামীর এলাকাতেই খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাতে বাধ্য
হচ্ছি।
ইমাদুরের একমাত্র মেয়ে তানিয়া (৬) জানায়, তার বাবা বেঁচে
থাকতে গুরুদাসপুর পৌরসদরের চাঁচকৈড় বাজারে প্রতিষ্ঠিত ‘খাতুনে জান্নাত
(রা.) বালিকা মাদ্রাসা’য় ভর্তি হয়েছিল। সেখানে মাসিক এক হাজার ২০০ টাকা করে
খরচ দিতে হতো। তার বাবা মারা যাওয়ার পর টাকার অভাবে তার পড়ালেখা বন্ধ।
তানিয়া জানালো, তার বাবা যেদিন বাড়ি ফিরতেন আপেল, কমলা আর বিস্কুট নিয়ে
বাড়ি ফিরতেন। এখন আর কেউ এসব নিয়ে আসে না। তার ভাষ্যমতে, ‘বাবা যেদিন
শেষবারের মত বাড়ি থেকে বের হয় সেদিন তার সাথে দেখা হয়নি। মাদ্রাসা থেকে
বাড়ি এসে জানতে পারে, তার বাবা কাজে চলে গেছে। মারা যাওয়ার আগের দিন অন্যের
ফোন থেকে বাবার খবর জানতে চেয়েছিল: বাবা কেমন আছো? ওপাশ থেকে বাবা
জানিয়েছিল: এখন ব্যস্ত আছি, পরে কথা বলবো। বলতে বলতে দুই চোখের পানি ধরে
রাখতে পারেনি শিশু তানিয়া।’
নাজিরপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান
মো. আইয়ুব হোসেন জানালেন, পরিবারটির দুরবস্থা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে
জানানো হয়েছে। কিন্তু কোন অনুদান মেলেনি। তবে তার পরিষদের পক্ষ থেকে
বিধবা ভাতা দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইয়াসমিন
আক্তার বলেন, বিষয়টি তার জানা নেই।
উপার্জনক্ষম সেই মানুষটি গত
১০ জানুয়ারি জয়পুরহাট থেকে আলু নিয়ে ঢাকায় যাচ্ছিলেন। বগুড়ার চণ্ডীহারা
এলাকায় পণ্যবাহী ট্রাকে ইট ছুঁড়ে মারে দুর্বৃত্তরা। ইটটি ইমাদুরের মাথায়
লাগে। পরদিন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়।