National news - নববর্ষের চাহিদা মেটাতে নিষিদ্ধ মওসুমেও বেশুমার ইলিশ নিধন

Image result for pic hilsa fish
মার্চ এপ্রিল, এই দুই মাসে মা হওয়ার অপেক্ষায় থাকে লাখ কোটি জাটকা ইলিশ। ইলিশের উত্পাদন বাড়াতে আইন করে এই সময়ে মত্স্য অভয়াশ্রমের নির্দিষ্ট এলাকায় মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আবার অন্যদিকে চলছে বর্ষবরণ উপলক্ষে পান্তা ইলিশের প্রস্তুতি। এ কারণে ইলিশ চাই-ই চাই। সুযোগ নিচ্ছেন জেলেরা, ব্যবসায়ীরা। নিষেধাজ্ঞা না মেনেই নদীতে চলছে ইলিশ ধরা। আবার ব্যবসায়ীরা দাম হাঁকছেন আকাশ ছোঁয়া। ভোজনপ্রিয়রা চড়া দামেই মাছ কিনে বাড়ি ফিরছেন।
মাছে-ভাতে বাঙালির ইলিশ প্রীতি নতুন কোনো বিষয় নয়। বাংলাদেশের জাতীয় এ মাছ এদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যেরও ধারক-বাহক। অবস্থা এমন হয়েছে, এখন পান্তা-ইলিশ ছাড়া বৈশাখ জমেই না। শহুরে মধ্যবিত্তের পান্তা-ইলিশ এখন অনেকটা শখের ব্যাপার। নববর্ষে নানা আয়োজনের মধ্যে মেলায় বসে মাটির সানকিতে পান্তা-ইলিশের দোকান। এ কারণে মৌসুম থাকুক বা না-ই থাকুক চাহিদার কারণে ইলিশ ধরাতে কোনো বিরতি নেই।
বাংলা নববর্ষের সঙ্গে পান্তা ইলিশের যোগসূত্র কবে থেকে তার সঠিক ইতিহাস নেই। রমনার বটমূলে পান্তা-ইলিশ চালু হওয়ার পর থেকে এ সংস্কৃতির বিস্তার ঘটে। এরপর থেকেই মূলত গ্রাম-শহরের সংস্কৃতির সঙ্গে একাকার হয়ে যায় পান্তা-ইলিশ। তথ্য অনুযায়ী, তিন দশক আগে চৈত্রের কোনো এক বিকালে আড্ডা দিচ্ছিলেন কয়েকজন সাংস্কৃতিক কর্মী। রমনা বটমূলের বৈশাখী আয়োজনে পান্তা-ইলিশের প্রস্তাব করেন একজন। এরপর অন্যরা সেটাকে সমর্থন করেন এবং ওই বছর থেকেই রমনা বটমূলে পান্তা-ইলিশ শুরু হয়।
তবে বছরের প্রথম দিনে ঘটা করে পান্তা-ইলিশ খাওয়ার সংস্কৃতিকে অনেকেই ভালো চোখে দেখেন না। এমনকি তারা বলছেন এর সঙ্গে বাংলার সংস্কৃতির কোনো সম্পর্ক নেই। অনেকেই আবার বলেন, শহরে পান্তা ভাত খাওয়া আমাদের ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ সংস্কৃতিকে ব্যঙ্গ করা। আজকাল শহরের মানুষের মধ্যে এমন একটা ধারণা তৈরি হয়েছে যে, বছরের শুরুর এ দিনটিতে ইলিশ না খেলে বছরটাই মাটি হয়ে যাবে।
রাজনৈতিক অস্থিরতার পরও এ বছরের ইলিশের দাম অন্য বছরের চেয়ে কম নয়, বলছেন ব্যবসায়ীরা। দাম বেশি হলেও নববর্ষের দিন ইলিশ খাওয়ার আয়োজনে কোনো কমতি দেয়। দাম যতই হোক বিক্রি হয়ে যাচ্ছে মাছ। মাওয়ায় গত মঙ্গলবার একটি ইলিশ পাইকারি বিক্রি হয়েছে ১৬ হাজার টাকায়। ২ কেজি ২শ’ গ্রাম ওজনের ইলিশটি আসে মাওয়ার ছানা রঞ্জন দাসের আড়তে। তিনি মাছটি বিক্রি করেন বিক্রেতা গয়া নাথ দাসের কাছে। গতকাল কাওরান বাজারে এক হালি ইলিশ বিক্রি হয়েছ ৪৮ হাজার টাকায়।
কাওরান বাজারের ব্যবসায়ী নেতা  কামাল হোসেনের মতে, দিনে ঢাকা শহরে দুই থেকে আড়াই কোটি টাকার ইলিশ বিক্রি হয়। এর মধ্যে কাওরান বাজারে বিক্রি হয় ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকার ইলিশ। শান্তিনগর মত্স্য ব্যবসায়ী সমিতির নেতা আবুল বাশার বলেন, প্রতিদিন এ বাজারে ৫০-৬০ হালি মাছ বিক্রি হয়, প্রতিহালি ১ হাজার থেকে ১২ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। তবে মাছ ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাজারে যে মাছ পাওয়া যাচ্ছে তা কোল্ড স্টোরেজ থেকে আসে।
তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট মত্স্য উত্পাদনে ইলিশ মাছের অবদান প্রায় ১১ শতাংশ। জিডিপিতে ইলিশ মাছের অবদান প্রায় ১ শতাংশ। বিশ্বের মোট ইলিশ উত্পাদনের ৫০-৬০ ভাগই বাংলাদেশে উত্পাদিত হয়, অবশিষ্ট ২০-২৫ শতাংশ মিয়ানমার, ১৫-২০ শতাংশ ভারতে এবং ৫-১০ শতাংশ অন্যান্য দেশে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দেশে ইলিশ উত্পাদিত হয়েছে ৩ লাখ ৮৫ হাজার টন।
ইলিশের উত্পাদন বাড়াতে জাটকা সংরক্ষণ, জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থান ও গবেষণার জন্য ২৪ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প চলমান রয়েছে। কৃষকদের জাটকা ধরাকে নিরুত্সাহিত করে এই সময়ের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবুও এই মৌসুমে মাছ ধরছেন তারা। আইনে বলা আছে, মত্স্য রক্ষা ও সংরক্ষণ আইন কেউ অমান্য করলে সর্বোচ্চ দু’বছর সশ্রম কারাদণ্ড অথবা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। তবুও অনেকে আইন মানছে না।
ইলিশ নিয়ে গবেষণা করা বিজ্ঞানীরা বলছেন, বছরের অন্যান্য সময়ের চেয়ে নববর্ষের আগে ইলিশ মাছের চাহিদা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। চাহিদা সঙ্কটের একমাত্র কারণ নয়। প্রতিবছর এপ্রিল মাসে নববর্ষ আসে কিন্তু এটা ইলিশ মাছের মৌসুম নয়। এটা ইলিশ মাছ ধরার মৌসুম নয়। ফলে এসময় বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় উত্পাদন ও আহরণ অনেক কম হয়। অন্যদিকে এ সময়ে চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারণে কিছুটা সঙ্কট দেখা যায়। তারা বলেন, নভেম্বর থেকে জুন পর্যন্ত জাটকা ইলিশ ধরা, ক্রয়-বিক্রয়, হেফাজতে রাখা ও পরিবহন নিষিদ্ধ। এছাড়া এ মাছ ধরার সবচেয়ে ভালো জায়গা (জিএসপি পয়েন্ট) চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, ভোলা, পটুয়াখালী ও শরীয়তপুরকে এ সময়ে ইলিশ মাছের অভয়াশ্রম ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়া পটুয়াখালী বাদে অন্য চারটি পয়েন্টে মার্চ থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে মাছ ধরার জাল ফেলাই নিষিদ্ধ। ১৯৮৫ সাল থেকে জাটকা (১০ ইঞ্চির নিচের ইলিশ) সংরক্ষণের প্রকল্প নেয় সরকার।
এই প্রকল্পের গবেষণা অংশের পরিচালক আনিসুর রহমান বলেন, ক্ষুদ্র ইলিশ থেকে যাতে মা ইলিশে পরিণত হতে পারে এ কারণে ইলিশ ধরতে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তবে নির্দিষ্ট মত্স্য অভয়ারণ্য ছাড়া গভীর সমুদ্র থেকে মাছ ধরতে বারণ নেই। কিন্তু জেলেরা অভয়াশ্রম থেকে মাছ ধরে গভীর সমুদ্রের কথা বলছেন। এ বিষয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর খেয়াল রাখা উচিত। তিনি বলেন, বাজার ঘুরে দেখা গেছে ১৫ থেকে ২০ ভাগ মাছ এই মৌসুমেই নদী থেকে ধরা। বাকি মাছ কোল্ড স্টোরেজ থেকে আসে।
তবে জেলেরা অবৈধভাবে জাটকা ধরছেন এমন তথ্যও রয়েছে প্রশাসনের কাছে। চাঁদপুরের মেঘনা নদীতে ফেব্রুয়ারিতে মাসব্যাপী অভিযান চালিয়ে ১৮ হাজার কেজি জাটকা আটক করেছে কোস্টগার্ড। ১ মার্চ বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলা সংলগ্ন মেঘনা নদীতে অভিযানে ঢাকাগামী লঞ্চ থেকে ৭০ মণ জাটকা জব্দ করা হয়। ২৩ মার্চ ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে সাভারের আশুলিয়া থেকে ৪০০ কেজি জাটকা আটক করা হয়। তবে ধরা পড়ছে না এমন অনেক ঘটনাই রয়েছে এমনটি জানিয়েছেন মত্স্য গবেষকরা।
-

Latest

Popular Posts

Popular Posts

Popular Posts