বরিশালে
শেষবার গিয়েছিলাম এক যুগ আগে, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি
অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতে। ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ২০১৫’ উদ্যাপন শেষে
রাত আটটায় আবারও সেই বরিশালের লঞ্চে উঠতে হলো বাংলাদেশ ভেটেরিনারি
কাউন্সিলের অনুরোধে। পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বরিশাল
ক্যাম্পাসের প্রাণিচিকিৎসার ছাত্রদের লেখাপড়ার মান যাচাইয়ে ওখানে তিন দিন
কাটিয়ে এলাম।
ওই শহরে আবদুর রব সেরনিয়াবাত টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আবদুল মজিদ শাহ শাকিল দুর্দান্ত পাখি পর্যবেক্ষক। আমার দেখা চৌকস পাখি পর্যবেক্ষকদের অন্যতম। বরিশাল এলাম, আর ওর সঙ্গে বার্ডিংয়ে গেলাম না, তা কি হয়? ২৪ ফেব্রুয়ারি রাতে ফিরতি লঞ্চ ধরার আগে সদর উপজেলার রুইয়া গ্রামে ওকে নিয়ে বের হলাম। দুই ঘণ্টার সফরে ২০ থেকে ২২ প্রজাতির পাখির দেখা পেলাম। কিন্তু এত পাখির মাঝেও একটি বিশেষ পাখিকে দেখার জন্য বেশ অস্থির ছিলাম।
এক বছর ধরেই শাকিল রুইয়া গ্রামের ওই পুঁচকে পাখিগুলোর খবরাখবর ফেসবুকে দিচ্ছিল। কিন্তু গত দুই মাস সে পাখিগুলোর দেখা পাচ্ছিল না। গ্রামটিতে ওদের বসবাসের জায়গা ও খাবারের উৎস ক্রমেই হুমকির মুখে পড়ছিল। গত বছর সুন্দরবনে উপযুক্ত পরিবেশে গিয়েও পুঁচকে পাখিগুলোর দেখা পাইনি। কুয়াকাটা গিয়ে খোঁজ করার কথা থাকলেও অতিরিক্ত গরমে প্রোগ্রাম বাতিল করেছি। এখানে এসেও ওদের দেখা পাব না শুনে খানিকটা হতাশই হলাম।
তবে জায়গামতো এসে তন্নতন্ন করে খুঁজলাম, পেলাম না। একবার একটু ডাক শুনলাম বলে মনে হলো, কিন্তু খুঁজে কূলকিনারা করতে পারলাম না। মন খারাপ করে মাঠের দিকে গেলাম। ওখানে পাখি দেখে ফিরতি পথে আরেকটু উঁকি মারতেই স্পষ্ট ডাক শুনলাম। সঙ্গে সঙ্গে ডাকের উৎসমুখে শাকিল ছুটে গেল। দুই মিনিটের মধ্যেই একটি চালতাগাছের ডালে ওর দেখা মিলল। উত্তেজনায় তখন দুজনই কাঁপছি। খানিকটা দম নিয়ে ভিউ ফাউন্ডারে চোখ রাখলাম। আলো কম, তার পরও বেশ কয়টা ক্লিক করলাম। মনে বেশ একটা আনন্দ নিয়ে ঢাকায় ফিরলাম।
আজকের গল্পের এই পুঁচকে পাখিটি আর কেউ নয়, এ দেশের বিরল আবাসিক পাখি ‘নীলকান মাছরাঙা’। ইংরেজিতে Blue-eared Kingfishers or Deep Blue Kingfisher or Malaysian Kingfisher। নীলাভকান ছোট মাছরাঙা নামেও পরিচিত। অ্যালসিডিনিডি পরিবারভুক্ত পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Alcedo meninting (অ্যালসেডো ম্যানিনটিং) অর্থাৎ গাঢ় নীল মাছরাঙা।
নীলকান মাছরাঙা দেখতে অনেকটা ছোট বা পাতি মাছরাঙার মতো হলেও আকারে আরও ছোট। লম্বায় ১৬ থেকে ১৭ সেন্টিমিটার ও ওজনে ২৩ থেকে ২৭ গ্রাম। দেহের ওপরটা গাঢ় নীল ও নিচটা গাঢ় কমলা। গালের চারদিক, ঘাড় ও ডানা-ঢাকনি বেগুনি-নীল। গলা ও ঘাড়ের পাশে সাদা পট্টি। কান-ঢাকনি উজ্জ্বল নীল। চোখ বাদামি। পা, পায়ের পাতা ও নখ গোলাপি-কমলা। ছোট মাছরাঙার সঙ্গে মূল পার্থক্য (কান-ঢাকনি কমলার পরিবর্তে নীল, দেহের রং গাঢ় নীল ও বুক-পেট গাঢ় কমলা। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম হলেও পুরুষগুলো বেশি উজ্জ্বল। পুরুষের উভয় ঠোঁট কালচে হলেও স্ত্রীর ওপরের ঠোঁট কালচে ও নিচের ঠোঁট লালচে-কমলা। অল্প বয়স্কগুলোর কান-ঢাকনি লালচে-কমলা ও ঠোঁটের অগ্রভাগে সাদা দাগযুক্ত।
নীলকান মাছরাঙা চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের মিশ্র চিরসবুজ বনের পাহাড়ি জলাধার ও ছড়া, সুন্দরবনসহ উপকূলীয় গরান বন, এমনকি বরিশাল-বাগেরহাটের গ্রামীণ বন-বাগানসংলগ্ন জলাশয় বা খালের পাশে বাস করে। সাধারণত একাকী বা জোড়ায় বিচরণ করে। পানির ওপরে ঝুলন্ত ডালের ওপর চুপচাপ বসে সুযোগের অপেক্ষায় থাকে এবং শিকার ধরতে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এরা পাতি মাছরাঙার মতো ন্যাড়া ডাল বা রোদে বসে না; ছায়াযুক্ত স্থান পছন্দ করে। ছোট ছোট মাছ ও জলজ পোকামাকড় খায়। শিকারের অপেক্ষায় বসে থাকার সময় বারবার মাথা ওঠানামা করে ও লেজ নাড়ায়। তীব্র স্বরে ‘চিচি...চিচিচি...চিচি’ শব্দে ডাকে।
ফেব্রুয়ারি-মে প্রজনন কাল। এ সময় খাল বা জলাশয়ের পাড়ে মাটিতে ৬০ থেকে ১০০ সেন্টিমিটার লম্বা গর্ত খুঁড়ে বাসা বানায়। বাসায় পাঁচ থেকে সাতটি উজ্জ্বল সাদা গোলাকার ডিম পাড়ে। রুইয়া গ্রামে গত বছর শাকিল চারটি বাচ্চাসহ যে নীলকান মাছরাঙা পরিবারকে পর্যবেক্ষণ করেছিল, আমাদের সেদিনের দেখা পাখিটি সম্ভবত এদেরই একটা। কামনা করি, এরা এ দেশে যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকুক।
ওই শহরে আবদুর রব সেরনিয়াবাত টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আবদুল মজিদ শাহ শাকিল দুর্দান্ত পাখি পর্যবেক্ষক। আমার দেখা চৌকস পাখি পর্যবেক্ষকদের অন্যতম। বরিশাল এলাম, আর ওর সঙ্গে বার্ডিংয়ে গেলাম না, তা কি হয়? ২৪ ফেব্রুয়ারি রাতে ফিরতি লঞ্চ ধরার আগে সদর উপজেলার রুইয়া গ্রামে ওকে নিয়ে বের হলাম। দুই ঘণ্টার সফরে ২০ থেকে ২২ প্রজাতির পাখির দেখা পেলাম। কিন্তু এত পাখির মাঝেও একটি বিশেষ পাখিকে দেখার জন্য বেশ অস্থির ছিলাম।
এক বছর ধরেই শাকিল রুইয়া গ্রামের ওই পুঁচকে পাখিগুলোর খবরাখবর ফেসবুকে দিচ্ছিল। কিন্তু গত দুই মাস সে পাখিগুলোর দেখা পাচ্ছিল না। গ্রামটিতে ওদের বসবাসের জায়গা ও খাবারের উৎস ক্রমেই হুমকির মুখে পড়ছিল। গত বছর সুন্দরবনে উপযুক্ত পরিবেশে গিয়েও পুঁচকে পাখিগুলোর দেখা পাইনি। কুয়াকাটা গিয়ে খোঁজ করার কথা থাকলেও অতিরিক্ত গরমে প্রোগ্রাম বাতিল করেছি। এখানে এসেও ওদের দেখা পাব না শুনে খানিকটা হতাশই হলাম।
তবে জায়গামতো এসে তন্নতন্ন করে খুঁজলাম, পেলাম না। একবার একটু ডাক শুনলাম বলে মনে হলো, কিন্তু খুঁজে কূলকিনারা করতে পারলাম না। মন খারাপ করে মাঠের দিকে গেলাম। ওখানে পাখি দেখে ফিরতি পথে আরেকটু উঁকি মারতেই স্পষ্ট ডাক শুনলাম। সঙ্গে সঙ্গে ডাকের উৎসমুখে শাকিল ছুটে গেল। দুই মিনিটের মধ্যেই একটি চালতাগাছের ডালে ওর দেখা মিলল। উত্তেজনায় তখন দুজনই কাঁপছি। খানিকটা দম নিয়ে ভিউ ফাউন্ডারে চোখ রাখলাম। আলো কম, তার পরও বেশ কয়টা ক্লিক করলাম। মনে বেশ একটা আনন্দ নিয়ে ঢাকায় ফিরলাম।
আজকের গল্পের এই পুঁচকে পাখিটি আর কেউ নয়, এ দেশের বিরল আবাসিক পাখি ‘নীলকান মাছরাঙা’। ইংরেজিতে Blue-eared Kingfishers or Deep Blue Kingfisher or Malaysian Kingfisher। নীলাভকান ছোট মাছরাঙা নামেও পরিচিত। অ্যালসিডিনিডি পরিবারভুক্ত পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Alcedo meninting (অ্যালসেডো ম্যানিনটিং) অর্থাৎ গাঢ় নীল মাছরাঙা।
নীলকান মাছরাঙা দেখতে অনেকটা ছোট বা পাতি মাছরাঙার মতো হলেও আকারে আরও ছোট। লম্বায় ১৬ থেকে ১৭ সেন্টিমিটার ও ওজনে ২৩ থেকে ২৭ গ্রাম। দেহের ওপরটা গাঢ় নীল ও নিচটা গাঢ় কমলা। গালের চারদিক, ঘাড় ও ডানা-ঢাকনি বেগুনি-নীল। গলা ও ঘাড়ের পাশে সাদা পট্টি। কান-ঢাকনি উজ্জ্বল নীল। চোখ বাদামি। পা, পায়ের পাতা ও নখ গোলাপি-কমলা। ছোট মাছরাঙার সঙ্গে মূল পার্থক্য (কান-ঢাকনি কমলার পরিবর্তে নীল, দেহের রং গাঢ় নীল ও বুক-পেট গাঢ় কমলা। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম হলেও পুরুষগুলো বেশি উজ্জ্বল। পুরুষের উভয় ঠোঁট কালচে হলেও স্ত্রীর ওপরের ঠোঁট কালচে ও নিচের ঠোঁট লালচে-কমলা। অল্প বয়স্কগুলোর কান-ঢাকনি লালচে-কমলা ও ঠোঁটের অগ্রভাগে সাদা দাগযুক্ত।
নীলকান মাছরাঙা চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের মিশ্র চিরসবুজ বনের পাহাড়ি জলাধার ও ছড়া, সুন্দরবনসহ উপকূলীয় গরান বন, এমনকি বরিশাল-বাগেরহাটের গ্রামীণ বন-বাগানসংলগ্ন জলাশয় বা খালের পাশে বাস করে। সাধারণত একাকী বা জোড়ায় বিচরণ করে। পানির ওপরে ঝুলন্ত ডালের ওপর চুপচাপ বসে সুযোগের অপেক্ষায় থাকে এবং শিকার ধরতে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এরা পাতি মাছরাঙার মতো ন্যাড়া ডাল বা রোদে বসে না; ছায়াযুক্ত স্থান পছন্দ করে। ছোট ছোট মাছ ও জলজ পোকামাকড় খায়। শিকারের অপেক্ষায় বসে থাকার সময় বারবার মাথা ওঠানামা করে ও লেজ নাড়ায়। তীব্র স্বরে ‘চিচি...চিচিচি...চিচি’ শব্দে ডাকে।
ফেব্রুয়ারি-মে প্রজনন কাল। এ সময় খাল বা জলাশয়ের পাড়ে মাটিতে ৬০ থেকে ১০০ সেন্টিমিটার লম্বা গর্ত খুঁড়ে বাসা বানায়। বাসায় পাঁচ থেকে সাতটি উজ্জ্বল সাদা গোলাকার ডিম পাড়ে। রুইয়া গ্রামে গত বছর শাকিল চারটি বাচ্চাসহ যে নীলকান মাছরাঙা পরিবারকে পর্যবেক্ষণ করেছিল, আমাদের সেদিনের দেখা পাখিটি সম্ভবত এদেরই একটা। কামনা করি, এরা এ দেশে যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকুক।