National news - ৩ সিটি নির্বাচন: কৌশল হিসাবে অংশ নেবে বিএনপি

৩ সিটি নির্বাচন: কৌশল হিসাবে অংশ নেবে বিএনপি
ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের বিষয়ে কৌশলী সিদ্ধান্ত নিতে পারে বিএনপি। এই নির্বাচনকে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি থেকে ‘সম্মানজনক নির্গমনের’ সুযোগ হিসেবে নেয়ার চিন্তা-ভাবনা করছে দলটির হাইকমান্ড এবং ২০ দলীয় জোট। দল ও জোটের প্রকাশ্য রাজনৈতিক তত্পরতায় আসার যুত্সই সুযোগ হিসেবেও দেখা হচ্ছে এটিকে। একইসঙ্গে ‘জনগণ বর্তমান সরকারের সঙ্গে নেই’ এবং ‘বিএনপির চলমান আন্দোলনের দাবি যৌক্তিক বা এর প্রতি জনসমর্থন রয়েছে’- জয়ী হয়ে দেশে ও আন্তর্জাতিক মহলে এরকম বার্তা দেয়ার লক্ষ্যে এই নির্বাচনকে ‘চ্যালেঞ্জ’ হিসেবে নেয়ার কথাও সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন ও ২০ দলীয় জোট প্রধান বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার গুলশান কার্যালয়ে সরাসরি আলাপ করেছেন- এরকম এক নেতা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার ইত্তেফাককে বলেন, ‘বিএনপিসহ ২০ দল এই নির্বাচনে মেয়র পদে জোট সমর্থিত প্রার্থী দেবে না বা এতে অংশ নেবে না, চেয়ারপারসনের সঙ্গে কথা বলে এমনটি আমার মনে হয়নি। বরং তার (খালেদা জিয়ার) কথাবার্তা ও শারীরিক ভাষায় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার বার্তা-ই প্রতীয়মান হয়েছে আমার কাছে।’ তাহলে কী ২০ দল নির্বাচনে লড়ার সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে? এরকম প্রশ্ন করা হলে- এই নেতার জবাব ছিল ‘আমার কাছে তো পজিটিভই (ইতিবাচক) মনে হয়েছে’।
অবশ্য খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার গুলশান কার্যালয়ে অবস্থান করা বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান গতকাল টেলিফোনে ইত্তেফাককে বলেন, ‘সিটি করপোরেশন নির্বাচন করা না করার বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হলে অবশ্যই সেটিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবেই নেয়া হবে।’
প্রসঙ্গত, নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী ঢাকার দুইটি ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ভোট গ্রহণ হবে আগামী ২৮ এপ্রিল। এতে মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষদিন ২৯ মার্চ।
জানা গেছে, সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা না করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে দল ও জোটের নেতাদের নিয়ে শিগগিরই বৈঠকে বসতে পারেন খালেদা জিয়া। কোনো কারণে বৈঠক করা সম্ভব না হলে বিভিন্ন মাধ্যমে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে পরামর্শ নেবেন। এ বিষয়ে নজরুল ইসলাম খান জানান, বৈঠকের বিষয়েও এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
২০ দল শরিক ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি) চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ বলেন ‘বৈঠক হোক আর না হোক, সিটি করপোরেশনের বিষয়ে জোটগত একটি সিদ্ধান্ত হবে। চলমান আন্দোলনের মধ্যে এই নির্বাচনের বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই আমাদের গভীরভাবে সবদিক ভাবতে হবে।’ জোটের আরেক শরিক এনডিপি চেয়ারম্যান গোলাম মোর্তুজাও জানান, ‘সিটি নির্বাচনে যেতে হলে চলমান আন্দোলনের বিষয়েও নতুন করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এজন্য ২০ দলের বৈঠক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’
বিএনপিসহ ২০ দলের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতার সঙ্গে পৃথকভাবে কথা বলে জানা গেছে, সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নেয়া বা না নেয়ার ব্যাপারে বর্তমানে কয়েকটি বিষয় বিচার-বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। প্রথমত: তাদের ধারণা বিএনপি-জামায়াত জোট সমর্থিত কোনো মেয়র প্রার্থীকে আসন্ন এই তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দেখতে আগ্রহী নয় ক্ষমতাসীন জোট। এতে সরকারি জোট ‘ফাঁকা মাঠে গোল’ করার সুযোগ পাবে; কিন্তু ২০ দল প্রার্থী দিলে সরকারি দল বা জোট সেই সুযোগ পাবে না। গত বছরের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো এবার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সরকারি দলকে ওয়াকওভার দিতে রাজি নয় ২০ দল। বরং ২০ দল বর্জন করলেও সরকার এই নির্বাচন করে ফেলবে, এরকম নির্ভরযোগ্য বার্তা রয়েছে তাদের কাছে।
দ্বিতীয়ত, বিএনপি ও এর নেতৃত্বাধীন ২০ দলের নেতৃত্বের বিশ্বাস— আন্দোলন-সংগ্রামে তেমন জনসম্পৃক্ততা না পেলেও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ২০ দল সমর্থিত মেয়র প্রার্থীর জয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। বাস্তবে এটি ঘটলে একদিকে রাজনীতির প্রধান দুই প্রাণকেন্দ্র রাজধানী ঢাকা ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামে চলমান আন্দোলন যেমন নতুন মাত্রা পাবে, তেমনি সারাদেশে এই বার্তাও যাবে যে—জনমত সরকারের বিরুদ্ধে। নির্দলীয় সরকারের অধীনে মধ্যবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের যে দাবি নিয়ে ২০ দল এখন আন্দোলনরত, সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জয় সেটির যৌক্তিকতার মানদণ্ড হিসেবেও কাজ করবে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মহলেও বার্তাটি পৌঁছে যাবে।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির পুনর্নির্বাচিত সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বুধবার খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে দীর্ঘক্ষণ আলাপ করেছেন। সেখান থেকে বের হয়ে খন্দকার মাহবুব হোসেন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়ে ইতিবাচক ইঙ্গিত দিয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘দল ও জোটের সঙ্গে আলোচনা করেই তিনি (খালেদা জিয়া) এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন। তবে বিএনপি এই নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবেই নেবে। দেশের মানুষ এ সরকারের সঙ্গে নেই, কাজেই বিএনপি কোনো নির্বাচনকেই ভয় পায় না। এই নির্বাচনেও অংশ নিলে বিএনপির প্রার্থী বিপুল ভোটে জয়ী হবে।’ 
তৃতীয় যে বিষয়টি ২০ দলের শীর্ষ নেতৃত্ব ভাবছে তা হচ্ছে, চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি থেকে বের হওয়ার একটি সম্মানজনক উপায় নিয়ে। তাদের মতে, গত আড়াই মাসের লাগাতার অবরোধ ও দুই মাস ধরে সপ্তাহের প্রতি কার্যদিবসে ডাকা হরতালেও প্রত্যাশিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেনি ২০ দল। বরং অবরোধ-হরতাল কর্মসূচি প্রায় অকার্যকর হওয়ার পাশাপাশি সরকার আরও হার্ডলাইনে হাঁটছে। এ অবস্থায় জোটের রাজনৈতিক কার্যক্রম স্বাভাবিক করতে দলীয় কার্যালয়গুলো খুলতে এবং পলাতক অবস্থা থেকে বের হয়ে জোটের নেতা-কর্মীদের প্রকাশ্য রাজনৈতিক তত্পরতায় আসার জন্য সিটি করপোরেশন নির্বাচন একটি বড় সুযোগ হিসেবে কাজ করতে পারে। এ ক্ষেত্রে ২০ দল নেতারা এটিও বলছেন, তফসিল ঘোষণা হওয়ায় এখন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসন নির্বাচন কমিশনের অধীনে থাকবে। এজন্য প্রশাসনের কাছ থেকে এক ধরনের নিরপেক্ষ আচরণ পাওয়ারও ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। যা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পাশাপাশি রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনেও কাজ দেবে।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও সুপিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির পুনর্নির্বাচিত মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনও বুধবার খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করেছেন। তিনি গতকাল ইত্তেফাককে বলেন, ‘সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে চেয়ারপারসনের সঙ্গে আমাদের আলাপ হয়েছে। তিনি আমাদের বলেছেন, ‘বিএনপি জনগণের দল, নির্বাচনকে ভয় পাওয়ার কারণ নেই।’
চতুর্থত, বিএনপিসহ ২০ দলের কারও কারও ধারণা— শেষ পর্যন্ত ২০ দল সমর্থিত মেয়র প্রার্থী দেয়া হলে নির্বাচন করা না করার বিষয়ে সরকার হয়তো নতুন করে ভাবতেও পারে। এক্ষেত্রে নির্বাচন করলেও ২০ দলের সুবিধা, না করলেও ২০ দল বলতে পারবে– সরকার পিছু হটেছে। আর নির্বাচন কমিশন যদি পক্ষপাতিত্ব করে, তাহলে এটিকেও আন্দোলনের নতুন ইস্যু তৈরির সুযোগ সৃষ্টি হবে। যা চলমান আন্দোলনের নতুন বাঁক হিসেবে কাজ করতে পারে।
বিএনপির একাধিক নেতার মতে, সামগ্রিক বিষয় বিচার-বিশ্লেষণ করেই আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ব্যাপারে ইতিবাচকভাবে ভাবা হচ্ছে। কারণ এর মধ্য দিয়ে ‘এক ঢিলে কয়েক পাখি মারার’ সুযোগ আসতে পারে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান গতকাল ইত্তেফাককে বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি গোটা দেশের জনমত আমাদের পক্ষে আছে। কাজেই নির্বাচনে অংশ নিলেও আমরা জয়ী হবো। যেভাবে এর আগে আমরা জয়ী হয়েছিলাম গাজীপুরসহ পাঁচটি সিটিতে। তবে এ ব্যাপারে দলীয় চেয়ারপারসনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন।’
-

Latest

Popular Posts

Popular Posts

Popular Posts