গরু-ছাগল চরে বেড়াচ্ছে। কোথাও কোথাও ক্রিকেট-ফুটবল খেলছে কিশোরেরা। এ দৃশ্য সিলেট নগরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া সুরমা নদীতে জেগে ওঠা চরের। সিলেট অঞ্চলের দীর্ঘতম নদী সুরমায় গত কয়েক বছর ধারাবাহিকভাবে পানি কমতে থাকায় শুষ্ক মৌসুমে নদীর বিস্তীর্ণ এলাকায় চর জেগে ওঠে। এতে করে নদীতীরবর্তী এলাকাগুলোতে আবাদি জমি থাকলেও পানির অভাবে ফসল ফলাতে পারছেন না কৃষকেরা। আর যেসব কৃষক চাষাবাদ করছেন, তাঁদের ফলনও আশানুরূপ হচ্ছে না।
গত সোমবার সরেজমিন ঘুরে এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সুরমা নদীর সিলেট অংশের ৭০ থেকে ৮০ কিলোমিটারের মধ্যে অন্তত ২০টি স্থানে চর জেগেছে। এর মধ্যে সিলেট নগর ও সদর উপজেলার কালিঘাট, মাছিমপুর, ঝালোপাড়া, আখালিয়া ঘাট, কুশীঘাট, মুক্তিরচক, কানিশাইল ও দক্ষিণ সুরমা উপজেলার কুচাই এলাকায় বিশাল বিশাল চর জেগেছে।
নদীতীরের কৃষকেরা জানান, শুষ্ক মৌসুমে নদীতে পানি কমে যাওয়ায় নদীতীরবর্তী গ্রামের কৃষকেরা ধান ও সবজি চাষে আগ্রহ ক্রমে হারিয়ে ফেলছেন। এ কারণে আবাদি জমিগুলোও এখন অনাবাদি হয়ে পড়ছে। পাঁচ বছর আগে নদীর যে অংশে শুষ্ক মৌসুমে পানির উত্তাল প্রবাহ ছিল, এখন সেখানে যত দূর চোখ যায় কেবল ধু ধু বালুচর। গত কয়েক বছরে ধীরে ধীরে এই পরিবর্তন হলেও দুই বছর ধরে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হয়েছে। এবার নদীতে বেশি জায়গাজুড়ে চর জেগেছে।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুর ও পরিবেশ প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষক মুশতাক আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, সুরমা নদীর পানি আসে মূলত ভারতের বরাক নদ এবং পাহাড়ি ঢল থেকে। এ পানি সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার অমলশিদ হয়ে প্রবাহিত হয়। কিন্তু সেখানে একটি বিশাল চর জাগায় পানির পুরো অংশই কুশিয়ারা নদীতে প্রবাহিত হচ্ছে। এ জন্য সুরমা নদীতে পানির প্রবাহ হ্রাস পাচ্ছে। এখন নদীটি কেবল ক্ষীণ একটি ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে। এর প্রভাব পড়েছে ফসল ও জীবনযাত্রার ওপর।
মুশতাক আহমদ আরও বলেন, সুরমা নদী এখন মূলত বিভিন্ন উপনদী থেকে পানি পাচ্ছে। উপনদীগুলোও দিন দিন অস্তিত্ব-সংকটে পড়ায় এ অবস্থা আরও খারাপ হবে। অথচ সুরমাকে ঘিরেই সিলেটের হাওরাঞ্চলের জীববৈচিত্র্য গড়ে উঠছে। সংগত কারণেই নদীতে চর জাগায় হাওরের জীববৈচিত্র্যেও সমস্যা হবে। এ ছাড়া যোগাযোগ, নাব্যতা ও কৃষিক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি হচ্ছে। ধীরে ধীরে ভূগর্ভস্থ পানিও কমবে, পানির স্তরও নিচে নামবে। তাই নলকূপ থেকে অতি সহজেই পানি পাওয়া যাবে না। এতে আর্সেনিক বাড়ার প্রবণতাও বৃদ্ধি পাবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সিলেট কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ভারত থেকে জকিগঞ্জের অমলশিদ হয়ে পাহাড়ি ঢলে প্রচুর পানি সিলেট অঞ্চলে প্রবেশ করে। এ পানির ৭০ শতাংশ সিলেটের কুশিয়ারা এবং ৩০ শতাংশ সুরমা নদী দিয়ে প্রবাহিত হয়। ঢলের সঙ্গে প্রচুর বালু ও পলি চলে আসায় প্রতিবছরই সিলেটের নদীগুলোতে স্তর পড়ে ভরাট হচ্ছে। এ কারণে নাব্যতা হারাচ্ছে নদীগুলো। এর মধ্যে সুরমা নদী নাব্যতা হারিয়ে চরম বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, মাঝখানে চর থাকায় নদীর পানির প্রবাহ অনেক স্থানে ক্ষীণ ধারায় আঁকাবাঁকা হয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। চর জেগে ওঠা স্থানে কিশোরেরা খেলা করছে। সিলেট সদর উপজেলার কানিশাইল এলাকায় চরের মধ্যে পলিথিনসহ ময়লা-আবর্জনার স্তূপ জমে উঁচু টিলার মতো চর তৈরি হয়েছে।
পাউবো সূত্র জানায়, অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় বর্তমানে সুরমা নদীতে পানির প্রবাহ আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। নদীটি নাব্যতা হারিয়ে ফেললেও এটি খননে কোনো প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নেই বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন।
পাউবো সিলেটের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী তাওহিদুল ইসলাম বলেন, ‘নাব্যতা হারিয়ে সুরমা অনেকটা মৃতপ্রায় নদীতে পরিণত হয়ে পড়েছে। শুকনো মৌসুমে এমন রূপ পায়। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। তবে নদী খননে আমাদের বিশেষ কোনো পরিকল্পনা নেই। এ অবস্থায় পাঁচ বছর পর পর খননের মাধ্যমে নিয়মিতভাবে নদীর পলি ও বালু অপসারণে কার্যকর পদক্ষেপ নিলেই নাব্যতা-সংকট দূর করা সম্ভব।’
বৃহত্তর সিলেট ইতিহাস প্রণয়ন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক কবি ও গবেষক শুভেন্দু ইমাম বলেন, ‘এ দেশের মানুষের কৃষি, জীবনযাপন, জীবিকা ও সংস্কৃতির সম্পর্ক নদীর সঙ্গে। তাই নদীবিহীন বাংলাদেশ কল্পনা করা যায় না। সুরমা যেহেতু দেশের প্রধান নদীগুলোর একটি, তাই এটিকে খননের মাধ্যমে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন।’