শুধু বাংলাদেশ নয়, বিদ্যুৎ ঘাটতি বৈশ্বিক সমস্যাই বটে। যেকোনো উপায়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন এ সমস্যার সমাধান হতে পারে না। পরিবেশের ওপর তার প্রভাব ভেবে দেখতে হচ্ছে সবার আগে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিবেশবান্ধব উপায় নিয়ে গবেষণা হচ্ছে সারা বিশ্বেই। আমাদের তরুণেরাও কিন্তু পিছিয়ে নেই। ঢাকার আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের (এআইইউবি) তড়িৎ কৌশল বিভাগের চার শিক্ষার্থী তৈরি করেছেন চাপ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পদ্ধতি, যা পাইজোইলেকট্রিসিটি নামে পরিচিত।
জনাকীর্ণ কোনো এলাকায় মেঝে বা ভূমিতে এ যন্ত্র স্থাপন করলে পথচারী হেঁটে গেলেই উৎপাদিত হবে নবায়নযোগ্য এই বিদ্যুৎ। এই প্রকল্পের দলনেতা মোহাম্মাদ হাবিবুর রহমান জানালেন খুঁটিনাটি।
স্মার্টফোন, ট্যাবলেট তো আছেই, হাতের নাগালে নানা কাজের পরিধেয় প্রযুক্তি পৌঁছাতেও খুব একটা বাকি নেই। সবকিছুর মূলে কিন্তু মানবজীবনের স্বাচ্ছন্দ্য। দিন দিন এই যন্ত্রগুলোর চাহিদা বেড়েই চলেছে। হাবিবুর রহমান জানালেন, ‘এই যন্ত্রগুলো কিন্তু কম বিদ্যুতে চলে। এ ধরনের যন্ত্রগুলোর জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা মাথায় রেখেই আমরা কাজ শুরু করি। ঢাকার কথাই বলি। ফার্মগেট ফুটওভার ব্রিজ দিয়ে দিনে অসংখ্য মানুষ যাতায়াত করে। সিঁড়ির প্রতিটি ধাপে যদি এই যন্ত্রগুলো বসানো যায় তবে ভালো পরিমাণের বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব।’
হাবিবুর রহমান প্রাথমিকভাবে নকশা করা যন্ত্রটি সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। হাতের নাগালে পাওয়া যায় এমন উপাদান দিয়ে এক বর্গফুট কাঠামো তৈরি করেছেন। তাতে বেশ কয়েকটি অংশ। তিন স্তরে কাঠের তক্তার মধ্যে ১২টি পাইজোইলেকট্রিক সেন্সর সমান্তরাল বিন্যাসে বসানো। এই পাটাতনে চাপ প্রয়োগে উৎপাদিত বিদ্যুৎ ব্যাটারিতে সংরক্ষণের উপযোগী ডিসি ভোল্টেজে রূপান্তরিত হয়ে জমা হয় ১.৩ অ্যাম্পিয়ার ১২ ভোল্টের একটি ব্যাটারিতে। ব্যাটারি থেকে এই বিদ্যুৎ বিভিন্ন কাজে লাগানো যায়। বহুল প্রচলিত এসি ভোল্টেজের প্রয়োজন পড়লে সঙ্গে থাকা ইনভার্টার ব্যাটারির ডিসি ভোল্টেজ এসি ভোল্টেজে রূপান্তর করে দেয়। যন্ত্রটি কীভাবে কাজ করে, জানতে চাইলে এভাবেই বলে গেলেন হাবিবুর রহমান। বিদ্যুৎ উৎপাদন করে বাতি জ্বালিয়েও দেখালেন।
সবচেয়ে বড় কথা স্বল্প খরচেই তৈরি করা সম্ভব এই যন্ত্র। প্রতি বর্গফুটের জন্য ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার টাকা খরচ পড়বে, এক সপ্তাহে বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে ৩.১৮ কিলোওয়াট। আপাতদৃষ্টিতে কম মনে হলেও বড় এলাকাজুড়ে স্থাপন করলে বিদ্যুৎ উৎপাদন কিন্তু বেড়ে যাবে। হাবিবুর রহমান জানালেন, মূল বিদ্যুতের বিকল্প না বরং সহায়ক হিসেবে রাখা যেতে পারে।
বাংলাদেশে নতুন হলেও কম্পন বা চাপ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ধারণা মোটেও নতুন না। প্রথম ১৮৮০ সালে ফরাসি পদার্থবিদ কুরি ভ্রাতৃদ্বয় পাইজোইলেকট্রিসিটি আবিষ্কার করেন। বর্তমানে অনেক দেশেই গবেষণা হচ্ছে, কাজেও লাগাচ্ছে।
এআইইউবির তড়িৎ কৌশল বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হাবিব মুহাম্মদ নাজির আহমেদের তত্ত্বাবধানে গবেষণাপত্রটি তৈরিতে হাবিবুর রহমানের দলে ছিলেন আমিরুল ইসলাম, আবু সালেহ আবীর এবং মোহাম্মাদ আশরাফুল আলম। তাঁরা একই বিভাগের শিক্ষার্থী।
বৃষ্টির ফোঁটা, রেললাইনের পাত, জুতার সোল কিংবা গাড়ির টায়ারের ভেতর এই যন্ত্রগুলো বসিয়েও বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। সবচেয়ে ভালো হয় যদি স্থির কিছুর নিচে স্থাপন করা যায়। আপাতত চাকরিজীবন শুরু করে পাইজোইলেকট্রিসিটি নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যেতে চান এর নির্মাতারা। কিছুটা হলেও লাঘব করতে চান দেশের বিদ্যুৎ ঘাটতি।